সিংগাপুর এবং ‘উপকারী একনায়ক’ লি কুয়ান ইউ
২০০৮ সালের জুলাই মাস। একটি মাসব্যাপী প্রশিক্ষণ কর্মসূচি উপলক্ষে সিংগাপুরের চাংগি বিমানবন্দরে অবতরণ করলাম। মাধ্যম সিংগাপুর এয়ারলাইন্স। কথা ছিল অফিস থেকে পিকআপ করবে, কিন্তু কথা কেউ রাখে নি। হয়তো রেখেছিলো, কিন্তু আমার সাথে দেখা হয় নি। অপরিচিত দেশে পাবলিক ট্রান্সপোর্টেও যাবার সাহস হলো না। ঘুমহীন রাতের ক্লান্তিতে এডভেন্চার করার ইচ্ছেটুকুও উধাও হয়েছে। অগত্যা বিমানবন্দরের বাইরে অপেক্ষমান ট্যাক্সিতে আসন নিলাম। ভোর সাড়ে ছয়টার সিংগাপুর। শুভ্র সকাল। গাড়ির উইন্ডো খুলে দিলাম বিদেশি হাওয়ার জন্য। নতুন দেশের আকাশ-বাতাশ, রাস্তাঘাট, ফুল ও পাখি সবকিছু নতুন। প্রাণভরে দেখতে থাকলাম। গাড়ির গতির কারণে দেখে শেষ করতে পারছিলাম না, যেন জোর করে আমাকে নিয়ে যাচ্ছে সামনে! নিমিষে রাতের ক্লান্তি দূর হয়ে গেলো।
অসম্ভব সুন্দর ও পরিপাটি এক শহর সিংগাপুর। প্রতি রবিবারে এমআরটিতে করে দোবিঘাট হয়ে মোস্তফামার্কেট বা লিটল চাইনা ইত্যাদি জায়গায় বিচরণ করতাম। ট্রেইনের টিকিট কেনা, ট্রেইনে ওঠা, সঠিক স্টেশনটিতে নামা, ট্রেইন পরিবর্তন করা, উদ্বৃত্ত অর্থ স্বয়ংক্রিয় মেশিন থেকে ফেরত নেওয়া – এই কাজগুলো বিশাল বড় চ্যালেন্জ হিসেবে দেখা দিলো। প্রতি মিনিটে একেকটি স্টেশন অতিক্রম করছে। ছুটির দিনেও ব্যস্ত মানুষের আনাগুনা। চাইনিজ, মালে, ইন্ডিয়ান, অষ্ট্রেলিয়ান, ইংলিশ নানারকমের মানুষের ভিড়। সকলকেই মনে হয় স্থানীয় – কেবল আমিই বিদেশি। তাদের হইহুল্লাকে অতিক্রম করে ট্রেনের ঘোষকের কথা মনযোগ দিয়ে শুনতে হতো। মোস্তফা মার্কেটে আসলে বাঙালিদের ভিড় দেখে তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য, দৈনিক পত্রিকা ইত্যাদি দেখে মনে হতো বাঙালি এক শহর। সপ্তাহব্যাপী কঠোর পরিশ্রমের পরও প্রবাসী বাঙালিদের চোখেমুখে প্রশান্তি ও সুখ ভেসে ওঠতো। সব দেখে মনে হতো সিঙ্গাপুরেই থেকে যাই!
প্রতিদিন সন্ধায় বের হতাম নিকটতম ডাউনটাউনে ঘুরেবেড়ানোর জন্য। একটি বহুজাতিক নগর কতটুকু বৈচিত্রময় হয়ে ওঠতে পারে সেটি না দেখলে বুঝানো কঠিন। কিন্তু এত বৈচিত্রের মাঝেও সবকিছুতে শৃঙ্খলা ও উন্নত সমাজের পরিচয় স্পষ্ট বুঝতে পারা যায়। একদিনে মেরিনা বিচ ও সেনতোজা আইল্যান্ড ভ্রমণ করে মুগ্ধ হলাম ট্যুরিজম শিল্পে সিংগাপুর সরকারের আগ্রহ, আয়োজন এবং অর্জন দেখে। শুধু ট্যুরিজম দিয়েই তাদের অর্থনীতি চালাতে পারে। কিন্তু না, এটিই তাদের আয়ের একমাত্র উৎস নয়, নৌবন্দর ব্যবস্থাপনা, জাহাজ মেরামত ব্যবস্থা, রপ্তানি প্রক্রিয়াজাতজরণ প্রভৃতি থেকে তাদের অর্থনীতি পরিচালিত হয়। হতদরিদ্র বা চরম দারিদ্র্তা সিংগাপুরে বিরল বরং মাথাপিছু মিলিয়নেয়ারের শতকরা হার পৃথিবীতে সর্বোচ্চ। সহজে ব্যবসা করার জন্য পৃথিবীর উত্তম স্থান হলো সিংগাপুর। এসব দেখে বাংলাদেশি হিসেবে একটি বিষয় নিয়ে আমি কৌতূহলী হলাম। বিষয়টি হলো, কারা সিংগাপুরকে চালায়, অথবা এদের শাসনতন্ত্র কীভাবে পরিচালিত হয়।
২) মালয়েশিয়ার পাশে মাত্র ৭১৮ বর্গকিলোমিটারের ছোট একটি নগররাষ্ট্র, সিঙ্গাপুর, ১৮১৯ সালে যার প্রতিষ্ঠা। সংস্কৃত ‘সিনহাপুরা’ থেকে মালয় সিঙ্গাপুরা শব্দটি আসে, যার অর্থ সিংহ নগর। সমস্ত শহরজুড়ে শিংহের আকৃতিসম্বলিত সিংগাপুর একটি দুর্নীতিমুক্ত স্বয়ংসম্পূর্ণ এবং আধুনিক রাষ্ট্র।
১৯৬৩ সালে ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে মুক্ত হবার পরপরই শহরটি মালয়েশিয়ার সাথে যুক্ত হয়ে মাত্র দু’বছর পর বহিষ্কৃত হয় (১৯৬৫)। সিংগাপুরকে কমিউনিস্ট মতবাদে প্রভাবিত মনে করে মালয় কতৃপক্ষ সিংগাপুরকে মালয়েশিয়া থেকে বের করে দেয়। নতুন স্বাধীনতাপ্রাপ্ত দ্বীপদেশ সিংগাপুর তখন সত্যিই বিপাকে পড়ে। স্বাধীন সিংগাপুরের প্রথম প্রধানমন্ত্রী লি কুয়ান ইউ এই বলে সিংগাপুরিয়ানদেরকে সাহস দেন: “এবিষয়ে দুশ্চিন্তা করার কিছু নেই। অনেককিছুই স্বাভাবিক নিয়মে চলে যায়। কিন্তু শক্ত হোন, শান্ত থাকুন। সিংগাপুরে আমরা একটি বহুবর্ণের জাতি গঠন করতে যাচ্ছি… প্রত্যেকেই স্থান পাবে, পাবে সমান অধিকার, ভাষা, সংস্কৃতি ও ধর্ম।” বিচ্ছিন্ন হবার সময়ে যারা সিংগাপুরে ছিল সকলেই সিংগাপুরিয়ান জাতীয়তা পেলো। সিংগাপুর হলো রিপাবলিক অভ্ সিংগাপুর। প্রধানমন্ত্রী শাসিত নির্বাচিত ও অনির্বাচিত প্রতিনিধি দ্বারা গঠিত ওয়েস্টমিনস্ট্রিয়াল গভর্নমেন্ট। কেউ কেউ বলে মিশ্র শাসনব্যবস্থা (হাইব্রিড গভর্নমেন্ট)।
ব্যবস্থা যা-ই হোক, ফলই যেহেতু পদ্ধতির বিচারক, সিংগাপুরের শাসনব্যবস্থাকে উত্তমই বলতে হয়। মেরিটোক্রেসির বাংলা যদি মেধাতন্ত্র হয়, তবে মেধাতন্ত্রই কায়েম করেছেন জনাব লি কুয়ান ইউ। মেধাই পদ ও দায়িত্ব পাবার একমাত্র উপায়। ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল ধারাবাহিকভাবে দেশটিকে সর্বনিম্ন দুর্নীতির (লিস্ট করাপ্ট) দেশ হিসেবে সনদ দিয়ে যাচ্ছে। আইনের শাসন কায়েম করাতেও সিংগাপুরের অবস্থান প্রথম সারিতে। হংকংয়ের পর এটি বিশ্বের দ্বিতীয় শীর্ষ মুক্ত-অর্থনীতির দেশ। রপ্তানিতে ১৪তম এবং আমদানিতে ১৫তম। এর সমুদ্রবন্দর পৃথিবীর ৫টি ব্যস্ততম বন্দরের মধ্যে একটি। উন্নত এবং প্রাণবন্ত অর্থনীতি।
৩) লি কুয়ান ইউর মৃত্যুতে সপ্তাহব্যাপী শোক পালিত হচ্ছে সমগ্র সিংগাপুরে। একান্নব্বই বছর বয়সে আধুনিক সিংগাপুরের জনক, পৃথিবী-বিখ্যাত রাষ্ট্রনায়ক এবং এশিয়ার জায়ান্ট লি কুয়ান ইউ মুত্যৃবরণ করেন (১৯২৩-২০১৫)। ১৯৬৫ থেকে শুরু করে ২০১১ সাল পর্যন্ত তিনি কোন-না-কোনভাবে সিংগাপুরের শাসনতন্ত্রে জড়িয়ে ছিলেন, কারণ তার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায় নি শাসনের মেয়াদ শেষ হবার পরও।
সারাবিশ্বের নেতারা তার মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করছেন। যুক্তরাষ্টের প্রেজিডেন্ট বারাক ওবামা তাকে ইতিহাসের বিশাল ব্যক্তিত্ব হিসেবে অভিহিত করেছেন; চীনা প্রেজিডেন্ট শি জিনপিং অভিহিত করেছেন বহুল সম্মানিত পরিকল্পনাবিদ হিসেবে; রাশিয়ার প্রেজিডেন্ট তাকে মনে করেছেন বিশ্বরাজনীতির একজন অভিভাবক; এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বলেছেন, দূরদর্শী রাষ্ট্রনায়ক।
একজন প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধানের মৃত্যুতে ৭দিন রাষ্ট্রীয় শোকের বিষয়টি নিঃসন্দেহে বিরল সম্মানের বিষয়। এর মধ্য দিয়ে সিংগাপুরের বিভিন্ন জাতিগোষ্ঠির জনগণ যেমন তাদের প্রাক্তন রাষ্ট্রপ্রধানের সম্মানে অভিন্ন অবস্থান প্রদর্শন করেছে, তেমনি রাষ্ট্রনায়ক ও একটি জাতির স্থপতি হিসেবে লি কুয়ান ইউ’র অবিসংবাদিত অবস্থানটুকু বিশ্ববাসী জানতে পারল আবারও। ভোটের জন্য বা সস্তা জনপ্রিয়তার জন্য কোন পলিসি গ্রহণ করলে বা কোন পদক্ষেপ নিলে আজকে তাকে কেউ এভাবে স্মরণ করতো না। সিংপুরিয়ানরা বহুজাতিক হলেও জাতির স্থপতির বিষয়ে নিজেদের ঐকমত্যের প্রমাণ রেখেছে। এমন একটি অবিসংবাদিত অবস্থান সৃষ্টি করার পেছনে লি-এর সর্ববাদি মনোভাব যে বিশেষ অবদান রেখেছে, এটা নিশ্চিত বলা যায়।
ধর্মের বিষয়ে লি ছিলেন নিরপেক্ষ এবং নিরাবেগ, কারণ তিনি ছিলেন সকল ধর্মের মানুষের রাষ্ট্রনায়ক। প্রথম বক্তৃতায়ই তিনি সকল ধর্ম ও সকল বর্ণের মানুষকে স্থান দেবেন বলে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন। দি গার্ডিয়ানের সাথে এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছিলেন: “ঈশ্বরের অস্তিত্ব আমি স্বীকারও করি না, অস্বীকারও করি না। তাই যারা ঈশ্বরে বিশ্বাস করে তাদের নিয়ে আমি হাসাহাসিও করি না।” তার এই মনোভাব নাস্তিক ও আস্তিক সকলের জন্য শিক্ষণীয় হয়ে থাকবে।
পশ্চিম সম্পর্কেও কোন অতিরিক্ত বাতিক ছিল না তার মনে। নিজ দেশের উন্নতির জন্য তিনি পশ্চিমের সাহায্য নিয়েছেন, ঠিক যতটুকু দরকার। “একটি কথা অকপটে বলি, পশ্চিমাদের ভালোদিকগুলো যদি আমাদের পথনির্দেশক না হয়, তবে পিছিয়েপড়া অবস্থা থেকে ওঠে আসতে পারবো না। পিছিয়েপড়া সমাজ নিয়ে একটি পিছিয়েপড়া অর্থনীতি আমরা পাবো। তবে পশ্চিমের সবকিছুই আমরা চাই না।”
সিংগাপুরের সৌভাগ্য যে লি-এর মতো একজন নেতা তারা পেয়েছিল, কারণ ব্রিটিশ উপানিবেশ থেকে মুক্ত করার সংগ্রাম থেকে শুরু করে, মালয়েশিয়া থেকে বিযুক্ত হওয়া পর্যন্ত লি কুয়ান ইউ সবসময় ছিলেন সিংগাপুরের জনগণের সঙ্গে। মালয়েশিয়া থেকে স্বাধীন হওয়ার পর শুরু হয় লি-এর জীবনের নতুন অধ্যায়। একই সাথে শুরু হয় স্বাধীন সিংগাপুরের নবযাত্রা। লি এবং সিংগাপুরের জীবন একাকার হয়ে যায় অবশেষে। এই সংমিশ্রণের সফল ছিল বলে আজ আমরা একটি পরিপূর্ণ রাষ্ট্র হিসেবে সিংগাপুরকে দেখতে পাই।
৪) সফল এবং প্রগতিশীল শাসক মানেই কিছুটা এহেম..ইয়ে… স্বৈরশাসক প্রকৃতির হয়! এশিয়ার অন্যান্য উন্নত দেশের (মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়া, দ. কোরিয়া ইত্যাদি) পর্বতসমান সমৃদ্ধির মূলেও রয়েছেন একেকজন সফল প্যাট্রিআর্ক, যাদের জনপ্রিয়তা মোটামুটি দেবতাতুল্য। এঁদেরকে আদর করে বলা হয়, benevolent dictator বা উপকারী স্বৈরাচার। (কী চমৎকার এক প্যারাডক্স!) লি কুয়ান ইউ ছিলেন তাদের আধুনিক সংস্করণ এবং প্রকৃষ্ট এক দৃষ্টান্ত। শক্তহাতে তিনি সিংগাপুরকে শাসন করেছেন এবং একটি রাজনৈতিক দলই ক্ষমতাসীন আছে দীর্ঘ দিন যাবত। দেশের সবকিছু রাষ্ট্রই নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণ করে। তার আমলে প্রজাদের বিয়েশাদির কাজেও সিংগাপুরের সরকার মধ্যস্থতা করেছে, যেন আদর্শ পারিবারিক বন্ধনের মাধ্যমে বের হয়ে আসে ভবিষ্যতের সুনাগরিক! স্থপতিরা একটু একনায়কতান্ত্রিক হবেনই, শুধু বাঙালিই বুঝলো না স্থপতির কী মূল্য! বাঙালি সফল শাসকের মূল্যও কতটুকু বুঝে কে জানে! আফসোস!
তথ্যসূত্র:
১) বিভিন্ন মাধ্যমে লেখকের ব্যক্তিগত অধ্যয়ন ও অনুসন্ধান।
২) আ হিস্টরি অভ্ সিংগাপুর (১৯৯১), আর্নেস্ট জিউ, (সম্পাদনায় এডউইন লি), অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি প্রেস।
৩) দ্য ডেইলি স্টার (বাংলাদেশ), দ্য গার্ডিয়ান (ইউকে), এবং উইকিপিডিয়া।
৪) চ্যানেল নিউস এশিয়া ডট কম।
আপনার লেখা সুন্দর, অকপটে বলা চলে। এগিয়ে যান, দোয়া রইল। এমন কিছু কি আমার দেশের জন্য ভাবা যায় না?
LikeLike
অনেক ধন্যবাদ আপনাকে, জনাব সিদ্দিকুর রহমান…
সত্যিই দেশের জন্য এমন হলে কতোই না ভালো হতো!
LikeLike
অনেক ভালো লাগলো আপনার এই পোস্টটি। আপনার ভ্রমন কাহিনীর সাথে সাথে জানলাম অনেক কিছু।
শুভেচ্ছা রইল প্রিয়।
LikeLike
ধন্যবাদ, সুখেন্দু দা’
LikeLiked by 1 person