সক্রেটিসকে হেমলক খাইয়ে মৃত্যুদণ্ড দেবার গোড়ার কারণটি ছিল, তিনি নিজেকে জ্ঞানী মনে করতেন এবং অন্যের জ্ঞান কেমন তা যাচাই করার জন্য সমাজের জ্ঞানী ও বিদ্বান ব্যক্তিদেরকে পরীক্ষা করতেন, অর্থাৎ যেখানে সেখানে তাদেরকে হেস্তনেস্ত করতেন। ওই বুদ্ধিজীবী অভিজাত সমাজটিই ক্ষেপে গিয়ে এথেন্সের আদালতে অভিযোগ পেশ করেছিলেন যে, সক্রেটিস যুব সম্প্রদায়কে বিপথে পরিচালিত করছেন।
.
.
সে যা-ই হোক, আসল কথায় আসি। সক্রেটিস যে জ্ঞানী এই দাবীর পক্ষে আদালতে তিনি এক হাস্যকর সাক্ষী দাঁড় করালেন: সেই সাক্ষী হলেন ডেলফির দেবতা। সক্রেটিস বললেন, বন্ধু চেরেফোন নাকি ডেলফির দেবতা এপোলোকে জিজ্ঞেস করেছিলেন, সক্রেটিসের চেয়ে অধিক জ্ঞানী আরও কেউ আছে কিনা। এপোলো তার সমুদ্রপ্রবাহী কণ্ঠে উত্তর দিয়েছিলেন, “না, আর কেউ নেই।” দেবতার এমন মূল্যায়ন শুনে তো সক্রেটিস রীতিমতো টাসকি খাইলেন, তা কী হয়? তিনি তো নিশ্চিত যে তার জ্ঞান নেই। তাহলে ডেলফির দেবতার এমন মতামতের মানে কী?
.
.
অতএব, তিনি বিষয়টি অনুসন্ধান করার সিদ্ধান্ত নিলেন। একজন জ্ঞানীকে খুঁজে বের করে তিনি ডেলফিতে নিয়ে গিয়ে প্রমাণিত করবেন যে, তার চেয়েও জ্ঞানী ব্যক্তি পৃথিবীতে আছে। সক্রেটিস তার দীর্ঘ অনুসন্ধানে দেখলেন যে, সমাজে যারা জ্ঞানী বলে পরিচিত তারা সত্যিকার অর্থে জ্ঞানী নন, যদিও সমাজ তাদেরকে সে আসনে বসিয়ে রেখেছে। তিনি দেখলেন যে, কবিরা জ্ঞান দিয়ে লেখেন না, তারা লেখেন প্রেরণা দিয়ে। অনেকেই নিজেকে জ্ঞানী মনে করেন, কিন্তু প্রকৃত বিচারে চূড়ান্ত জ্ঞানের বিষয় কারও কাছেই নেই। শিল্পী কারিগর ও বিশেষজ্ঞদের কাছে গিয়ে দেখলেন যে, তিনি সত্যিই তাদের চেয়ে অনেক কম জানেন। নিজ নিজ বিষয়ে তারা কত কিছুই না জানেন! কিন্তু তাদেরও রয়েছে চরম সীমাবদ্ধতা – নিজ বিষয় ছাড়া অন্য সকল বিষয়েই তারা মূর্খ।
.
.
যত বেশি খ্যাতিমান, তিনি দেখলেন যে, ততই বেশি কম জানেন। সক্রেটিস হতাশ হয়ে তাদেরকে বলে আসতেন, “আপনি বা আমি, আমরা কেউই জ্ঞানী নই। তবে আপনার চেয়ে আমার জ্ঞান একটুখানি বেশি এই অর্থে যে, আমি অন্তত এতটুকু জানি যে আমি কিছুই জানি না। এই ‘জানি না’ জ্ঞানটুকুও আপনার নেই।”
সক্রেটিসের এই চরম ঝুঁকিপূর্ণ জরিপে অগণিত ‘জ্ঞানীলোক’ তার শত্রু হলেও একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নের উত্তর তিনি পেয়েছিলেন। তিনি বুঝতে পেরেছিলেন কেন ডেলফির ওই দেবতা তাকে জ্ঞানী বলে স্বীকৃতি দিয়েছিলেন। পরিপূর্ণ জ্ঞান কারও কাছেই নেই। হাজার বছর পরেও অজুত অজুত বিষয় এখনও মানুষের অজানা রয়েছে। কিছু কিছু বিষয় হয়তো অজানাই থেকে যাবে। সক্রেটিস জ্ঞানী ছিলেন এই যুক্তিতে যে, তিনি তার মানবিক অজ্ঞতা সম্পর্কে অবগত এবং স্পষ্টবাদী ছিলেন। অতএব সে-ই জ্ঞানী যিনি তার অজ্ঞতার ‘রকম ও পরিমাণ’ জানেন এবং নিজের অজ্ঞতায় যার কোন দ্বিধা নেই। এই মতামত মহাজ্ঞানী সক্রেটিসের। (১৮ অক্টোবর ২০১২)
.
.
.
অবলম্বন: ১) সক্রেটিসের জবানবন্দি নিয়ে প্লেটো’র এপোলজি; এবং ২) সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় রচিত “বরণীয় মানুষ স্মরণীয় বিচার”।
.
.
“অতএব সে-ই জ্ঞানী যিনি তার অজ্ঞতার ‘রকম ও পরিমাণ’ জানেন এবং নিজের অজ্ঞতায় যার কোন দ্বিধা নেই।”
এক নিঃশ্বাসে পড়ে ফেললাম। অনেক ভালো লাগলো।
শুভেচ্ছা রইলো প্রিয়।
LikeLike
হাহা! ধন্যবাদ, সুখেন্দু বিশ্বাস দা!
LikeLike
অনেক ধন্যবাদ….
আপনার নিয়মিত পদচারণায় আমি প্রেরণা পাচ্ছি….
সুখেন্দু বিশ্বাস দাদা!
LikeLike
অতএব সে-ই জ্ঞানী যিনি তার অজ্ঞতার ‘রকম ও পরিমাণ’ জানেন এবং নিজের অজ্ঞতায় যার কোন দ্বিধা নেই। …বাহঃ চমৎকার একটি লেখা পড়লাম মইনুল ভাই।হৃদয়ের আওয়াজ ই পেলাম ..হৃদয়ের কথা শুনলাম ।সক্রেটিস এর এই লেখার পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্লেষনে মনে হল আমরা সবাই ….মানুষের জ্ঞান এখন ও কত সীমিত।চিন্তা করে দেখুন যাকে আমরা জ্ঞানী বলে ভাবছি হয়ত তার দেখা যাচ্ছে বিশেষ এক বিষয়ে জ্ঞান ..যা বলে কিনা বিশেষজ্ঞ বা বিশেষভাবে অজ্ঞ।তাই হয়ত বলা জানা বা জ্ঞানের সীমা নেই।পরম সৃষ্টিকর্তা এভাবে বিশ্বভ্রমান্ডকে আমাদের জ্ঞানের অগোচরে রেখেছেন দুই তৃতীয়াংশ।আমাদের সার্চ /অনুসন্ধান ..আকাঙ্খায় তা হয়ত আনফোল্ড হয় একসময়। তা ও বলুন এমন একজন তো যিনি সৃষ্টিকর্তার রহস্য, সৃষ্টির রহস্য।আমাদের ধর্মে বলা হয়েছে সৃষ্টিকর্তার রহস্য নিয়ে জানতে চেওনা ।হি ইজ ইনফিনিট হি ইজ জিরো।যদি তাকে না জানি যিনি আমাদের সৃষ্টি করেছেন তবে সৃষ্টির বাকী রহস্য ..জ্ঞান সম্পর্কে কিভাবে অবহিত হব তাইনা?
আপনার এই ব্লগ আমার ভীষন পছন্দ হয়েছে।আমি ও আমার হৃদয়ের আওয়াজ দিয়ে গেলাম ….ভবিষ্যতে দিয়ে যাব আশা করি..ভাল থাকবেন মইনুল ভাই।
LikeLiked by 1 person
আপনার আন্তরিক মন্তব্যে যথারীতি অনুপ্রাণিত হলাম, আরজু মুন জারিন!
হৃদয়ের আওয়াজ পেয়ে আনন্দিত 🙂
আপনিও একটি ব্লগ খুলে দেখতে পারেন ওয়ার্ডপ্রেসে….ভালো লাগবে, গ্যারান্টি।
LikeLike
ভাবছিলাম তাই।আমার ফেসবুক এ তো একই কাজ করছি।আপনার মত হৃদয়ের আওয়াজ দিয়ে যাচ্ছি।ফেসবুক তো ব্লগে পরিবর্তন করা যাবেনা না? নুতুন ব্লগ করতে গেলে নুতুন লেখা লিখতে হবে ।তারচেয়ে বড় কথা মইনুল ভাই নুতুন লেখা যে লিখব ..সব ব্লগার রা লেখক ..লেখা এখন কেও পড়তে চায়না দেখি।আপনি কষ্ট করে একটা লেখা লিখবেন মানুষের সচেতনতা বৃদ্ধির জন্য,সমাজের উপকারের জন্য ..যাদের জন্য লিখব তারা ই তো পড়েনা ..না পড়লে লিখে কি লাভ ? আপনি পড়বেন আমি জানি ..সচেতন বলে..লেখাতো পাঠকের পড়ার জন্য।আমি যখন বুঝব সবাই আমার লেখা আগ্রহ করে পড়বে তখন ই লিখব..
ভাল থাকবেন মইনুল ভাই।
LikeLike
//নুতুন লেখা যে লিখব ..সব ব্লগার রা লেখক ..লেখা এখন কেও পড়তে চায়না দেখি।//
-হাহাহা…. খাঁটি কথা… পাঠক নেই, সবাই লেখক যে!
তবু লেখে যান… সৃষ্টি করে যান…
সেটি আপনার তাগিদে… পাঠকের চিন্তা না করে।
কৃতজ্ঞতা এবং শুভেচ্ছঅ…
LikeLike
হাই,মাঈনউদ্দিন ভাই আশা করি ভাল আছেন,
অবশ্য ভাল থাকারই কথা,যার লেখা পড়ে মানুষের
মন ভাল থাকে,সে কি ভাল না থাকতে পারে,,
ইদানিং আপনার নতুন আওয়াজ পাচ্ছি না,
নতুন আওয়াজ চায়,নতুন আওয়াজের অপেক্ষায় আছি,,,
LikeLike
প্রথমেই সালাম ও ধন্যবাদ। তারপর বলছি, অনেক দুঃখিত ভাই, সময়মতো আপনার মন্তব্যটির উত্তর না দিতে পারার জন্য। অনেকদিন পর লগইন করলাম। আওয়াজ অবশ্যই পাবেন। অনেক শুভেচ্ছা!
LikeLike