প্রডিজি বয় আরভিনের কথা
[১৯২০ সালের আরভিন: জন্ম ১৯০৩ বুদাপেস্ট/হাঙ্গেরি – মৃত্যু ১৯৮৭ লসএন্জেলেস/যুক্তরাষ্ট্র]
‘আরভিন’ তার নাম হলেও বালকের পুরো নাম বিকট আকৃতির। বয়স ২ বছর হতেই খেলনা পিয়ানো পেয়েছিলো হাতে। তাতেই সে পেয়ে যায় পিয়ানো শেখার হাতেখড়ি। হাঙ্গেরিতে জন্ম আর যুক্তরাষ্ট্রে বড় হওয়া এই বিস্ময় বালকের ঘটনাটি ২০১১ সালের সেপ্টেম্বরে পড়েছি একটি ব্যবস্থাপনা সম্পর্কিত পুস্তকে। গল্পটি খুব বড় নয় কিন্তু গভীর তাৎপর্যে মুগ্ধ হয়েছিলাম। মানুষের জীবন-যাত্রায় সাথে আরভিনের জীবনের অনেক মিল আছে। আরভিনের করুণ কাহিনী ভীষণভাবে নাড়া দিয়েছিলো সেদিন।
ফিরে যাচ্ছি প্রডিজি বয় আরভিনের কথায়। তৃতীয় বছরে এ বালক তার খেলনা পিয়ানোতে সুর তুলে মা-বাবাসহ প্রতিবেশিকে একদিন মুগ্ধ করে দেয়। চতুর্থ বছরে সে তার সুরগুলো সঙ্গীতের সংকেতে লিখতে শুরু করে দেয়। চার বছরের বালকের জন্য এরকম দক্ষতার কথা শুধু নিকটবর্তীরাই বিশ্বাস করবে।
জার্মানের ‘বার্লিন সিম্ফোনিতে’ আরভিন যখন পিয়ানো বাজানোর গৌরব অর্জন করে, তখন তার বয়স মাত্র ১২। এবছরে তার সঙ্গীতজ্ঞ পিতা মৃত্যুবরণ করেন। যা হোক, ১৫ বছর বয়সে নরওয়ের মহামান্য রাজা ও রানির সামনে আরভিন পিয়ানো পরিবেশন করেন। আরভিনের সঙ্গীত প্রতিভা তখন প্রায় বিশ্বে প্রচারিত। তার সুখ্যাতি ইউরোপ ছাড়িয়ে আমেরিকায় গিয়ে পৌঁছায়। বছর দুই পরে নিউ ইয়র্কের বিখ্যাত কার্নেগি হলে আরভিন পিয়ানো পরিবেশন করে মার্কিনিদের তাক লাগিয়ে দেন। সঙ্গীতের তাত্ত্বিকরা ততদিনে মারভিনকে তুলনা করতে শুরু করেন কিংবদন্তী মোসার্টের (Mozart) সাথে। পুরো নাম আরভিন নিরেজিহাসা। বয়স মাত্র ১৭।
কিন্তু পঁচিশ না হতেই অজানা কারণে আরভিন লোকচক্ষুর আড়ালে চলে যায়। অবস্থা এমন হলো যে, আরভিন যেন পৃথিবীতেই নেই। থাকলেও সঙ্গীতের সাথে তার কখনও পরিচয় ঘটে নি। প্রায় ৭০০ কম্পোজিশনের শ্রষ্ঠা আরভিনকে মনে হলো, সে কোন দিন মঞ্চে ওঠে নি। সঙ্গীতের দোকানে নেই তার নাম। কারণ সেগুলো কখনও প্রকাশ পায় নি।
মানুষ কখনও বুঝতে পারলো না, বিশ্বকাঁপানো পিয়ানো-বিস্ময় কিশোর আরভিনের কী হলো! বিশ্বের সেরা পিয়ানো বাদকদের তালিকায় আরভিনকে পাওয়া যাবে না। খ্যাতিমান পিয়ানো বাদকেরা মারভিনকে চিনবেন না। প্রজন্মের পরিবর্তনে এক সময় আরভিনের কথা মানুষও ভুলে গেলো। বিষয়টি রহস্য হয়ে থাকলো অনেক বছর।
হঠাৎ একদিন সানফ্রান্সিসকো’র (ক্যালিফোর্নিয়া) এক জীর্ণ হোটেলের সামনে এক বৃদ্ধকে দেখা গেলো পিয়ানোতে পুরান সুর তুলতে। রাস্তার পাশে বিনামূল্যে পিয়ানো বাজিয়ে শুনাচ্ছেন ৭৫ বছর বয়সী আরভিন! অকাল-পক্ক খ্যাতি পাবার ৫৫ বছর পর যখন জীবনের সব চাওয়া-পাওয়া শেষ, আরভিন তখন নিজের মূল্য উপলব্ধি করলেন। তিনি বুঝতে পারলেন, পরবর্তি প্রজন্মের জন্য তার ৭০০ সুরের পিয়ানো কম্পোজিশনগুলো রেকর্ড করে রাখা চাই।
কী হয়েছিলো আরভিনের? সহজ এই প্রশ্নের সরল উত্তরটি হলো: আরভিন জীবনের ভার সহ্য করতে পারেন নি। অতি অল্প বয়সেই তিনি সব পেয়েছিলেন। ভক্তদের চাপ, অনাকাঙ্ক্ষিত প্রেম, জনতার প্রত্যাশা, সঙ্গীতের স্বভাবজাত আবেগের চাপ, খ্যাতির নিজস্ব কিছু যন্ত্রণা – ইত্যাদি বিষয় আরভিন ঠিকমতো সামাল দিতে পারছিলেন না। মানসিক, শারীরিক ও আবেগিক ধারায় নিজেকে ধরে রাখতে পারেন নি আরভিন। তিনি মনে করেছিলেন, সবকিছু তাকে কেবল তাকেই মোকাবেলা করতে হবে। নিষ্ঠুর একাকিত্ব পেয়ে বসেছিল আরভিনকে।