গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস: স্বীকৃতি পাওয়ার আগে ও পরে
পুরস্কার বা স্বীকৃতির বিষয়গুলোতে বাংলাদেশের হুমায়ুন আজাদের মতোই মার্কেস ছিলেন বিপরীতমুখী। ১৯৮১ সালে অর্থাৎ নোবেল পুরস্কারের পূর্বের বছরটিতে তাকে একবার প্রশ্ন করা হলো: লেখক হিসেবে তার উচ্চাকাঙ্ক্ষা কেমন। উত্তরে তিনি বলেছিলেন, নোবেল প্রাইজ পাওয়া হবে তার লেখক সত্ত্বার জন্য বিধ্বংসী, কারণ লেখককে তখন ‘খ্যাতি’র সাথে সংগ্রাম করতে হবে। খ্যাতি লেখকের ব্যক্তিগত জীবনকে আক্রান্ত করে এবং এটি তাকে বাস্তব সমাজ থেকে বিচ্ছিন্ন করে দেয়। “এভাবে আমি বলতে চাই না, কারণ এটি কখনও বিশ্বাসযোগ্য হবে না। তবে আমি সত্যিই চাইব আমার লেখাগুলো মৃত্যুর পরে প্রকাশিত হোক, যেন আমাকে খ্যাতি এবং বিখ্যাত লেখকের চাপে না থাকতে হয়।”
মজার ব্যাপার হলো নোবেল প্রাইজ অর্জনের পর তার আশংকা অনেকটাই সত্য হয়েছে, যদিও অন্যভাবে। তার লেখক সত্ত্বার যা-ই হোক, মার্কেস দেশের রাজনীতিতে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিত্বে পরিণত হন। বিখ্যাত লেখকের সুনাম দিয়ে মার্কেস কলাম্বিয়ার অভ্যন্তরিণ রাজনৈতিক সমাধানে কার্যকর ভূমিকা পালন করেন এবং সরকারের সাথে যুদ্ধরত গেরিলাদের শান্তি আলোচনায় অবদান রাখেন। লেখকের খ্যাতি দিয়ে কিউবান প্রেজিডেন্ট ফিদেল ক্যাস্ট্রোর সাথে নিজ দেশের জন্য সম্পর্ক বৃদ্ধি করতে সমর্থ হন। উল্টো ঘটনাও ঘটেছে: যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদের বিপক্ষে এই সেলিব্রেটি লেখক প্রকাশ্য অবস্থান নেবার কারণে দীর্ঘদিন ইউএস ভিজা থেকে বঞ্চিত হন।
উল্লেখযোগ্য সাহিত্যকর্ম:
•উপন্যাস: ১) ইন ইভিল আওয়ার/ দুঃসময়ে; ২) ওয়ান হানড্রেড ইয়ারস অভ সলিটিউড/ নিঃসঙ্গতার একশ’ বছর; ৩) লাভ ইন দ্য টাইম অভ্ কলেরা/ কলেরার সময়ে প্রেম (ইত্যাদি);
•ছোট গল্প: ৪) আইজ অভ্ আ ব্লু ডগ/ নীল কুকুরের চোখ; ৫) বিগ মামা’র ফিউনারেল/ বড় মা’র অন্ত্যেষ্টিক্রিয়া (ইত্যাদি);
•ছোট উপন্যাস/ নোভেলা: ৬) লিফ স্টর্ম/ পাথার ঝড়; ৭) নো ওয়ান রাইটস টু দ্য কর্নেল/ কর্নেলের কাছে কেউ লেখে না। ‘লিফ স্টর্ম’ উপন্যাসটি মার্কেসের প্রথম ফিকশন।
জন্ম ও লেখক সত্ত্বার উদ্ভব
কলাম্বিয়ায় জন্মগ্রহণ করেন ১৯২৭ সালে। মার্কেসের ছেলেবেলা কেটেছে পারিবারিক গল্প শুনতে শুনতে। বাবা ফার্মাসিস্ট হবার কারণে জন্মের পরেই নানাবাড়িতে এবং নানার কাছেই বড় হয়েছেন গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস। নানা ছিলেন একজন চৌকষ মিলিটারি অফিসার এবং নিজ এলাকায় সম্মানীত একজন ব্যক্তি। সেই সাথে তিনি ছিলেন এক সম্মোহনী গল্পকার। গল্প, ভাষা এবং নৈতিক শিক্ষা সবই তিনি পেয়েছেন তার নানার কাছে থেকে। বাবা-মা ফার্মেসি ব্যবসা নিয়ে অন্যত্র অবস্থান করায় তারা ছিলেন এক প্রকার অপরিচিত, মার্কেসের কাছে।
ছেলেবেলার আরেকটি বিষয় মার্কেসের লেখক-সত্ত্বাকে প্রভাবিত করেছে। তা হলো, বাবা-মায়ের ঘটনাবহুল বিবাহ-পূর্ব প্রেম। মার্কেসের ‘কর্নেল নানা’ কোনভাবেই তার মেয়ের সাথে গাব্রিয়েল এলিজিও গার্সিয়াকে (মার্কেসের বাবা) মেনে নিতে চান নি। এলিজিও নারী-প্রেমী বা ওমেনাইজার হিসেবে সমাজে পরিচিত ছিলেন এবং ছিলেন কনসার্ভেটিভ পার্টির একজন কর্মী। বিষয়গুলো লুইসা সান্তিয়াগার (মার্কেসের মা) বাবা পছন্দ করতেন না। এলিজিও বীণা বাজিয়ে, প্রেমের কবিতা লিখে, অগণিত প্রেমপত্র এবং এমন কি টেলিগ্রাফ পাঠিয়ে লুইসার মন জয় করার চেষ্টা করতেন। এ পরিস্থিতিতে তাদের মধ্যে দূরত্ব তৈরি করার উদ্দেশ্যে বাবা (মার্কেসের নানা) লুইসাকে দূরে পাঠিয়ে দিলেন। কিন্তু সম্পর্কটি ছিন্ন করার জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করেও এলিজিওকে থামাতে পারেন নি। অবশেষে তারা বাধ্য হলেন লুইসাকে এলিজিও’র হাতে তুলে দিতে। অবাধ্য প্রেমের মজার কাহিনীটি মার্কেসের ‘লাভ ইন দ্য টাইম অভ্ কলেরা’ গল্পে ফুটে ওঠেছে।
আইন বিষয়ে পড়াশুনা শেষ করে মার্কেস সাংবাদিকতা দিয়ে তার লেখক জীবন শুরু করেন। বিভিন্ন পত্রিকায় কলাম লেখেছেন তিনি। তবে আল হেরাল্ডো নামের স্থানীয় পত্রিকার সাথে কাজ করার সময় একটি লেখক সংঘের সাথে যুক্ত হন মার্কেস। তিনি নিয়মিতভাবে চলচ্চিত্রের সমালোচনা এবং রিভিউ লিখতেন, যা পরবর্তিতে সাহিত্য সৃষ্টিতে প্রচ্ছন্নভাবে প্রভাব সৃষ্টি করেছে।
মার্কেসের ৭টি ‘জটিল’ উদ্ধৃতি: পাঠক এবারও হুমায়ুন আজাদের সাথে মিল পাবেন!
১) যখন মরা উচিত মানুষ তখনই মরে না যদিও সে তা পারে।
২) খুব বেশি অপেক্ষা করলে কমই পাওয়া যায়।
৩) ঈশ্বরকে আমি বিশ্বাস করি না। তবে তাকে আমি ভয় করি।
৪) সবসময় মনে রাখবেন, বিয়ের মধ্যে সুখি হওয়াটাই গুরুত্বপূর্ণ নয়, দীর্ঘস্থায়ি হওয়াটাই আসল।
৫) সত্যিকার বন্ধু হলো সে, যে হাতে হাত রেখে হৃদয়কে স্পর্শ করে।
৬) ঈশ্বর রবিবার দিনটিতে বিশ্রাম না করলে হয়তো পৃথিবীটি ভালোভাবে গড়তে পারতেন।
৭) আমার মুখের ভেতর দিয়ে যাকিছু প্রবেশ করে তা আমাকে মোটা বানায় – যাকিছু মুখ থেকে ‘বের’ হয়ে আসে তা আমাকে লজ্জিত করে।
শেষ জীবন ও শেষ কথা
শেষের দিকে নিজের জীবন নিয়ে মেমোয়ার বা স্মৃতিকথা প্রকাশে বেশি সময় দেন মার্কেস। লিভিং টু টেল দ্য টেইল শীর্ষক জীবনীগ্রন্থটি ২০০৩ সালে ইংরেজিতে প্রকাশিত হয়। কিন্তু ১৯৯৯ সালে ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে কেমিকেল থেরাপি নিতে গিয়ে স্মৃতিশক্তির লোপ পায়। ২০০৫ বছরটিতে প্রথমবারের মতো কিছুই লিখতে পারেন নি বলে আক্ষেপ করেছিলেন মার্কেস। ফলে গত এক দশকে আগের সেই প্রলিফিক রাইটার হিসেবে মার্কেসকে আর পাওয়া যায় নি। গত ১৭ এপ্রিল ২০১৪ তারিখে মেক্সিকোতে নিজ বাড়িতে মৃত্যুবরণ করেন দক্ষিণ আমেরিকার সংগ্রামী মানুষের প্রতিনিধি গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস।
দক্ষিণ আমেরিকান দেশগুলো আমাদেরই মতো বৈষম্য আর সাম্রাজ্যবাদের বিপক্ষে সংগ্রাম করে একেকটি নক্ষত্র হিসেব আজ পৃথিবীর মানচিত্রে জায়গা করে নিয়েছে। বাংলাদেশ এবং বাঙালি তাদের বিপ্লবে নিজেদেরকে দেখতে পায়। বাঙালি চে গুয়েভারার চেতনায় নিজেকে দেখে, কারণ ইতিহাস তাদের অভিন্ন। পাবলো নেরুদার সংগ্রামী চেতনায় যেমন বাঙালি যেমন আপ্লুত হয়েছে, ঠিক সেরকম ভাবেই মার্কেসের লেখা ও তার পরবর্তি জীবন দ্বারা প্রভাবিত হয়েছিলো। মার্কেস বাংলাদেশে এসেছিলেন এবং বাঙালি আথিতিয়েতায় মুগ্দ হয়েছিলেন। তিনি সাক্ষাৎকার দিয়েছেন বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন পত্রিকা ও টিভিতে। মার্কেসের মৃত্যু পৃথিবীর তাবৎ মানুষগুলোর সাথে বাংলাদেশিকেও করেছে শোকাহত।
—————–
গ্রন্থপঞ্জি:
ক. লিভিং টু টেল দ্য টেইল (২০০৩)। গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস। নি্উইয়র্ক।
খ. দ্য গার্ডিয়ান, লন্ডন।
গ. নোবেল প্রাইজ হোমপেইজ।
ঘ. ওয়ান হানড্রেড ইয়ার্স অভ্ সলিটিউড (১৯৭০)।গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেস। নি্উইয়র্ক।
ঙ. ছবি ইন্টারনেট থেকে সংগৃহীত।
—————–
লেখাটি ইতোপূর্বে সামহোয়ারইন এবং জলছবি বাতায়ন ব্লগে প্রকাশিত হয়েছে, যথাক্রমে ১৮ এপ্রিল এবং ২৫ এপ্রিল ২০১৪ তারিখে।