প্রথম আলো ব্লগের ‘প্রিয়চিঠি আয়োজনে’ চিঠি নির্বাচন: মাটির ময়না’র চিঠি
[[ প্রিয় চিঠি আয়োজন নিয়ে প্রকাশিত মোট চারটি লেখায় ‘সাহিত্য আয়োজন’ সম্পর্কে আমার অভিমত, অভিজ্ঞতা এবং পরামর্শ নির্দ্বিধায় প্রকাশ করেছি। সহব্লগারদের যেকোন লেখায় যেমন দ্বিধাহীন মতামত দেই, এক্ষেত্রেও আমার স্বভাবের ব্যতিক্রম করি নি। এবার নির্বাচকের ভূমিকায় থেকে নিজের দ্বিধার সাথে একটু বেশিই যুদ্ধ করেছি এবং ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা থেকে ‘আয়োজক-আয়োজিত’ সকলের সম্পর্কেই মন্তব্য করেছি। কেউ পড়েছেন, কেউ আবার মন্তব্য দিয়ে উৎসাহিতও করেছেন। সকলকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা! ]]
পরিস্থিতির সার্বিক মূল্যায়ন করে, প্রিয়চিঠি নির্বাচনে বেশকিছু বিষয়কে মাপকাঠি হিসেবে ব্যবহার করেছি। তাদের মধ্যে ৩টি বিষয় সম্মানীয় সহব্লগারদের উদ্দেশ্যে তুলে ধরছি:



২) প্রিয়চিঠি নির্বাচন এবং নির্বাচিত হবার ভিত্তিঅনেক দ্বিধাদ্বন্দ্বের মুখোমুখি হয়ে প্রথমে ১৬৫ থেকে ২০, তারপর ৩টি চিঠিতে আমি প্রাথমিকভাবে দৃষ্টি নিবদ্ধ করি। ওপরে উল্লেখিত শেষ ৩টি চিঠিকে আলাদা করে আয়োজকের কাছে প্রেরণ করি। তিনটি চিঠিকে নির্বাচন করলেও আমি অগ্রাধিকার নম্বর উল্লেখ করেছিলাম। অন্যান্য নির্বাচককে সুযোগ দেবার জন্যই ওই ব্যবস্থাটি রেখেছিলাম। অবশেষে মাটিরময়না’র ‘লাল রঙে রাঙাইয়া দিমু তোমার সিঁথি’ শীর্ষক চিঠিটি আমি চূড়ান্ত বলে নির্বাচন করার সুযোগ পাই। অধিকাংশ চিঠিতেই লিখিতভাবে আমার তাৎক্ষণিক মন্তব্য দিয়েছি। তাই শুধু চূড়ান্তভাবে নির্বাচিত চিঠি সম্পর্কে আলোচনা করছি, এবং উল্লেখিত শর্তাবলীর আলোকে আমার ব্যক্তিগত মূল্যায়ন তুলে ধরছি:
স্ত্রীর প্রতি স্বামী চিঠি। এটি স্বাভাবিক কোন প্রেমের চিঠি নয়। মৃত স্ত্রীর কাছে একজন অসহায় নিগৃহীত স্বামীর চিঠি। দেশ সমাজ সংসার এবং শেষে পুত্রের কাছে নিগৃহীত এক পিতার হাহাকার। চিঠিতে ফুটে ওঠেছে আমাদের সূর্যসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের বর্তমান জীবন চিত্র। চিত্রিত হয়েছে একটি অকৃতজ্ঞ সমাজের ধ্বংসের ছবি। শুধু চিঠি বললে ভুল হবে, অল্প কথায় একটি সমাজচিত্র।
চিঠির পটভূমি
“আমি যখন যুদ্ধ থাইকা আইলাম ফিইরা, তোমারে সিদুর দিতে গেছলাম যখন তুমি তো আমারে সিদুর লাগাইতে দিলা না। দিব্যি দিলা তোমার বইনের ইজ্জত লইয়া যেই রাজাকারের বাইচ্চারা খেলছে তাগো ভগবার বিচার না করা পর্যন্ত তুমি সিদুর দিবা না। রতনের মা, তুমি চাইয়া দেখো চাইরদিকে, দেশের বাতাসে এহন বিচারের গর্জন, তাগো বিচার করতাছে ভগবান। ভগবান কারো মাপ দেই নাই রতনের মা। তুমি আমার লাইগা অপেক্ষা করো রতনের মা, আমি আইতাছি লাল রঙ্গে রাঙ্গায় দিমু আমি তোমার সিথিঁ।”
চিঠিতে বহুমুখী পটভূমি রচনা করা হয়েছে বহুমুখী উদ্দেশ্যে। এখানে আছে মুক্তিযুদ্ধ, সাম্প্রদায়িকভাবে ছোট একটি গোষ্ঠির মুক্তযুদ্ধে অংশগ্রহণের সাক্ষ্য আর আছে সন্তানের কাছে পিতার প্রবঞ্চনার চিরচেনা চিত্র। আমি লক্ষ্য করেছি মুক্তিযুদ্ধের পটভূমি এবং একজন মুক্তিযোদ্ধার জীবন যুদ্ধের বিষয়টি। যদিও যোদ্ধাপরাধের বিচার নিয়ে রাজনীতি হচ্ছে বিভিন্ন পক্ষে, তবু বিচারের আবশ্যকতা তুলে ধরা হয়েছে চিঠিটিতে।
চিঠির বক্তব্যে সমাজ সংশ্লিষ্টতা
“তুমি শুনলে অনেক খুশি হইবা, তোমার রতন এখন অনেক বড় হইছে। অনেক বড় সাহেবের চাকরী করে সে। মেলা টাকা রোজগার করে। অনেক কথা কইতেও শিখছে আমাগো রতন। আমারে সেদিন কইলো, তার এই ছোড ঘরের মধ্যে আমি থাকলে তার পরিবারের কষ্ট হইয়া যায়। জায়গা নাকি অনেক কম ঘরে। ও, রতনের মা, এতো বড় একটা ঘরের মইধ্যে আমি সারে পাচঁ ফুটের একটা মানুষ কতো আর জায়গা খাই?”
আমাদের সমাজ অনেক এগিয়ে গেছে….প্রবৃদ্ধির হার বেড়েছে…..মাথাপিছু আয় বেড়েছে…..কর্মসংস্থান বেড়েছে। সে সাথে পাল্লা দিয়ে বেড়েছে সমাজের অবক্ষয়। পশ্চিমা ‘এবং প্রতিবেশী প্রাচ্যের’ আগ্রাসনে বেড়েছে সাংস্কৃতিক চরিত্রহীনতা। মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি তো দূরের কথা পিতার স্বীকৃতিই মিলছে না আজ। আমরা হয়তো নিকৃষ্ট দৃষ্টান্তগুলো হয় দেখি না, না হয় মনে রাখি না – অথবা দু’একটা উত্তম দৃষ্টান্ত দেখে আত্মতৃপ্তিতে থাকি। কিন্তু যারা এসব প্রবঞ্চনার শিকার, তাদের কাছে উত্তম বলে পৃথিবীতে কিছু নেই। যেমন নেই, রিক্সাওয়ালা মল্লিক মিয়ার কাছে, যিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়ে দেশের জন্য জীবন বাজি রেখেছিলেন।
পাঠকের মনে আবেদন সৃষ্টি করার ক্ষমতা
“দুই যুগ হয় আমি তোমার হাতের পায়েস খাইনা। তোমার সেই ঘন্টার পর ঘন্টা সময় দিয়ে পায়েস আর কেউ বানায় না গো । সেই কষ্ট, সেই মায়া, সেই ভালোবাসা আর কোন পায়েসে আমি পাইনা। ভগবানের কাছে মাঝে মাঝে কই তোমারে কি একটা দিনের জন্য ছুটি দেয়া যায়না?…… তোমার চুলে দেয়া সেই বাসনা তেলের বোতলটা এখনো রাইখা দিছি ……আইচ্ছা রতনের মা, ঐ পারে গেলে কি মানুষের চুল পাকে? তোমারও কি চুল্পাইকা গেছে? নাকি এহনো , যেমন আছলা তেমন আছো? ……. আমি সেই আগের মতো জোয়ান নাই গো রতনের মা। তবুও কি পারবা আমারে চিনতে?”
মুক্তিযুদ্ধ বাঙালির ‘অবসেশন’ – বাঙালির অস্তিত্ব। মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযোদ্ধাকে নিয়ে লিখিত চিঠিতে রয়েছে আমাদের সামাজিক অবক্ষয়ের চিত্র। ফলে চিঠির বিষয় ইতিমধ্যেই পাঠকের মন কেড়েছে। চিঠিতে আবেগ ছিলো কানায় কানায় পূর্ণ, যা প্রথম থেকেই পাঠকের নজর আটকে দেয়। এ আবেগ যথার্থ পরিমিত এবং প্রাসঙ্গিক। চিঠি পড়লে কখনও মনে হবে না এটি ‘সুকুদা’ ছাড়া অন্য কেউ লেখেছে। প্রতিটি অনুচ্ছেদ যেন একেকটি প্লট।
৩) মাটির ময়নার চিঠিতে ‘পাখির চোখে দৃষ্ট’ বিষয়গুলো
*বিষয়: মৃত স্ত্রীর কাছে স্বামীর চিঠি
*পটভূমি: মুক্তিযুদ্ধ এবং মুক্তিযুদ্ধ পরবর্তি সামাজিক জীবন
*লেখকের ভঙ্গি: স্ত্রীর প্রতি সমাজ, সন্তান ও জীবন নিয়ে অনুযোগ
*মূল বক্তব্য: একজন স্বাধীনকর্মীর পরাধীন জীবনে মৃত্যুর অপেক্ষা আর মৃত স্ত্রীর সাথে সাক্ষাতের অপেক্ষা।
*ভাষা: চলিত এবং আঞ্চলিক ভাষার ‘আরামদায়ক’ মিশ্রণ
*লেখার আকার: ৬৮২ শব্দ, ৬ অনুচ্ছেদ, ১.৫ পৃষ্ঠা।
*ঘটনা পরিক্রমা: “রতনের মা, তোমারে ছাড়া আমি হাপাই গেছি।আর কতো পথ চলুম একলা একলা?” সঙ্গীহারা ‘সুকুদা’র অনুযোগ দিয়ে শুরু চিঠি শুরু হলেও লেখক দক্ষতার সাথে গেয়ে গেছেন সমাজ পরিবর্তন আর অবক্ষয়ের গান। স্বাধীনতা পরবর্তি পারিবারিক ও সামাজিক অবক্ষয়ের শিকার হয়েছেন স্বাধীনতা-কর্মী ‘সুকুদা’।
নিজ পুত্রের কাছে প্রবঞ্চনার শিকারও হয়েছেন। প্রিয়তমা স্ত্রীকে ঠিক আগের মতোই দেখতে চান সুকুদা, যেমন দেখেছিলেন ২৬ বছর আগে। সৎভাবে চাকরি করতে না পেরে চাকুরি ছেড়ে দেন। এক ফাঁকে বলে যান, মুক্তিযোদ্ধা মল্লিক মিয়ার কথা, যে এখন রিক্সাওয়ালা। স্বজনহীন সুকুদা এখন মৃত্যুর দিন গুণে সময় অতিক্রম করছেন, যেমন অনেক মুক্তিযোদ্ধা করছেন আমাদের সময়ে।
৪) অন্যান্য পাঠকের অভিমত
সম্মানীত সহব্লগার মাটিরময়নার চিঠিটিতে কয়েকজন সহব্লগারের মন্তব্যকে আমি উল্লেখিত শর্তাবলীর সাথে প্রাসঙ্গিক মনে করছি:
রব্বানী চৌধুরী: এ চিঠি যেন সমাজের দর্পন। মন ছুঁয়ে যাওয়া চিঠি। আবেগের ছোঁয়ায় লেখা এ চিঠি খুব ভালো লাগলো।
মেঘনীল: ছুয়ে গেলো। শুরুটা যেমন করলা শেষটা ও দারুন। একটানা পড়ার পড়ে একটা হাহাকারবোধ জন্ম নিলো।
নুসরাত জাহান আজমি: আমাদের সমাজের বেশকটি সমস্যাই তুলে ধরা হয়েছে চিঠিটাতে। গত হওয়া স্ত্রীর কাছে স্বামীর দুই যুগ পর লেখা চিঠিটাতে আবেগ ছিল অনেক বেশি।
ফেরদৌসী বেগম শিল্পী: দুঃখ-কষ্ট, প্রেম-ভালোবাসা আর দেশপ্রেম সব মিলিয়ে বেশ সুন্দর চিঠি লিখেছেন মাটিরময়না ভাই। ভীষণ ভালো লাগলো।
ঘাস ফুল: মৃত স্ত্রীর কাছে লেখা চিঠিটার মধ্যে কয়েকটা গুরুত্বপূর্ণ বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। রতনের মধ্যে দিয়ে ফুটে উঠেছে বাবা মার প্রতি সন্তানদের অবজ্ঞার কথা, আবার কিছু দুর্নীতির কথা। রতনের বাবা চাকুরি হারায়/সময়ের আগেই অবসর নিতে বাধ্য হয় দুর্নীতিকে মেনে নিতে পারে নাই বলে। মুক্তির জন্য যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করা হল, কিন্তু এখনো কি আমাদের মুক্তি মিলেছে, সেই প্রশ্নটাও ওঠে এসেছে চিঠির মধ্যে। মুক্তিযোদ্ধাদের করুন চিত্রও চিঠিতে ছোট্ট আকারে তুলে ধরেছ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধে সংখ্যা লঘুদের অংশগ্রহণের ব্যাপারটি ওঠে এসেছে।
৫) যা বলা যায় এবং যাদেরকে বলা যায় – তার সবই তাদেরকে বললাম!
প্রিয় চিঠি আয়োজন নিয়ে প্রকাশিত মোট চারটি লেখায় ‘সাহিত্য আয়োজন’ সম্পর্কে আমার অভিমত, অভিজ্ঞতা এবং পরামর্শ নির্দ্বিধায় প্রকাশ করেছি। সহব্লগারদের যেকোন লেখায় যেমন দ্বিধাহীন মতামত দেই, এক্ষেত্রেও আমার স্বভাবের ব্যতিক্রম করি নি। এবার নির্বাচকের ভূমিকায় থেকে নিজের দ্বিধার সাথে একটু বেশিই যুদ্ধ করেছি এবং ব্যক্তিগত দায়বদ্ধতা থেকে ‘আয়োজক-আয়োজিত’ সকলের সম্পর্কেই মন্তব্য করেছি। কেউ পড়েছেন, কেউ আবার মন্তব্য দিয়ে উৎসাহিতও করেছেন। সকলকে আন্তরিক কৃতজ্ঞতা!
প্রিয় চিঠি: ‘লাল রঙে রাঙাইয়া দিমু তোমার সিঁথি’
———————————————————-
প্রিয়চিঠি আয়োজন উপলক্ষে পূর্বতন লেখাগুলো:
প্রাক-নির্বাচনী বক্তব্য ১: প্রাপ্তির কথা
প্রাক-নির্বাচনী বক্তব্য ২: নির্বাচক হিসেবে চ্যালেন্জগুলো
প্রাক-নির্বাচনী বক্তব্য ৩: ভবিষ্যৎ আয়োজনের জন্য কিছু পরামর্শ