ইংলিশ বাংলিশ: আপনার ‘লেদার’ কি ফর্সা?
এক) আপনার ‘লেদারের’ রঙ কি ফর্সা?
আমার এক ফুফাতো ভাইয়ের ইংরেজিতে কথা বলার কঠিন ইচ্ছাশক্তি ছিলো। আমি তখন ষষ্ঠ কি সপ্তম শ্রেণীর ছাত্র। কথায় কথায় তিনি আমাকে ইংরেজি জিজ্ঞেস করতেন। ট্রান্সলেশন এবং বাংলা শব্দের ইংরেজি জানার জন্য আমাকে নাস্তানাবুদ করে রাখতেন। এমন কি পড়ার সময়ও আমার পাশে বসে থাকতেন। তিনি আমাকে স্নেহ করতেন। আমি কমপক্ষে দশ বছরের ছোট হবো তার।চক্ষুলজ্জার কারণে অন্যকে এসব জিজ্ঞেস করতেন না। আমি ভয়ে কোন আপত্তিও করতে পারতাম না, কারণ রাগলে খবর আছে। ভীষণ বদমেজাজী; তার বড়ভাইকেও মারার রেকর্ড তিনি ততদিনে করে রেখেছিলেন। সুঠাম দেহী, ফর্সা এবং দীর্ঘাকায়। পড়াশুনা বেশি করতে পারেন নি বিশেষ কারণে।
.
তার ইংরেজি বলার পদ্ধতিটি ছিলো বেশ মজার। বাংলা শব্দের ইংরেজিগুলো নিয়ে ‘নিজের মতো’ সাজিয়ে ইংরেজি বাক্য বলা। যেমন, আমি এখন গোসল করতে যাবো। তিনি সকল শব্দেরই ইংরেজি জানেন, শুধু ‘গোসল’ শব্দটি ছাড়া। তো আমাকে তার জিজ্ঞাসার বিষয়টি হলো ‘গোসলের’ ইংরেজি শব্দ কী? ধরুন, আমি তখন বললাম ‘বাথ’।
তিনি বাস্তবিকই এমন একটি পরিস্থিতিতে আছেন। অর্থাৎ, আমাকে অনেকক্ষণ বিরক্ত করার পর আসলেই এবার তার গোসলের সময় হয়েছে। তিনি হঠাৎ বলে ওঠলেন: “আই নাউ বাথ গো!” এই হলো তার ইংরেজি বলার কায়দা! কেমন বুঝলেন? কিন্তু আমি তখন কিছুই বুঝতাম না। মনে করতাম, ওটা ঠিকই আছে। কোন কিছু জিজ্ঞেস করার পূর্বে তার সবচেয়ে প্রচলিত ইংরেজি বাক্যটি হলো, হেলপ ডু। মানে ‘সাহায্য কর!’ জিজ্ঞেস করে জেনে নেবার সুযোগ না হলে বাংলা বাক্যের মধ্যেই তিনি তার সাধ্যমতো ইংরেজি শব্দ জুড়ে দিতেন।
.
পারিবারিকভাবে তাদের সকল ভাই-বোনের ফর্সা ত্বক। পক্ষান্তরে আমাদের বাড়ির সকলেরই গায়ের রং গাঢ়। মা-বাবার গায়ের রঙ শ্যামল হলেও আমরা ভাইবোনদের প্রায় সকলেরই গায়ের রঙ তামাটে। একদিন জিজ্ঞেস করলেন, “আমাকে বল তো, চামড়া শব্দের ইংরেজি কী?” কী উদ্দেশ্যে ‘চামড়া’ শব্দের ইংরেজি চাচ্ছেন আমি তখন বুঝি নি। আমি বললাম ‘লেদার’।
তিনি সাথে সাথে তার বাক্য ডেলিভারি দিয়ে বললেন, “তুই তো জানিস আমাদের পরিবারের সবারই ‘লেদার’ কিন্তু ফর্সা। অথচ, তোর ফুফু (মানে তার মা) কেমন একটি কালো মেয়েকে আমার জন্য দেখেছে। আচ্ছা তোদের ‘লেদার’ এতো কালো কেনো রে?” আমি তো একদম আঁতকে ওঠলাম, কিন্তু হাসলেই খবর আছে! হাড্ডি একটাও আস্ত থাকবে না! কী অভিনব ইংরেজি! ইংরেজরাও তার ইংরেজির মানে করতে পারবে না!
এরকম দৃষ্টান্তের অভাব নেই আমাদের চারপাশে।
.
.
দুই) ঈদ তো গেলো, কী কী ‘মার্কেটিং’ করলেন?
এটি একটি বহুল প্রচলিত মিসইউজ অভ ইংলিশ, যা কেবল বাংলাদেশী শিক্ষিতদের মধ্যে পাওয়া যায়। কত সুন্দর একটি বাংলা শব্দ ‘কেনাকাটা’। সেটি ব্যবহার না করে ইংরেজি ভাষার বারোটা বাজাতে এত ভালো লাগে! যারা বাজারজাতকরণ বিষয়টি নিয়ে স্নাতকোত্তর পড়ালেখা করেন, অর্থাৎ ‘মার্কেটিং’ এর ছাত্ররাও এ ভুলটি থেকে মুক্ত নয়। আহারে, আমরা যদি সত্যিই সকলে ‘মার্কেটিং’ করতাম, তাহলে ভিনদেশি বিজ্ঞাপনে আমাদের টিভি আর বিলবোর্ডগুলো ভরে থাকতো না! যা হোক, কেনাকাটা অর্থে ইংরেজি শব্দটি হবে ‘শপিং’।
.
আসসালামু আলাইকুমের পরিবর্তে আজকাল ‘গুড মর্নিং/আফটারনুন/ইভনিং/নাইট’ ব্যবহৃত হচ্ছে। বিশেষত বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে ধর্মনিরপেক্ষ শুভেচ্ছার প্রচলন বেড়ে গিয়েছে। এমনই একটি প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকার সুবাদে আমাকেও গুড মর্নিং গুড আফটারনুন ইত্যাদি শুনতে হয় এবং শুনাতেও হয়। আমার এক সহকর্মী যাকে সম্প্রতি একটি পৌর এলাকায় স্থানান্তর করা হয়েছে, সাধারণত ‘আদাব’ বলেই শুভেচ্ছা জানায়। অন্তর্মুখী টাইপের ছেলে: সামনাসামনি তাকাতেই লজ্জায় মরে, কথা বলবে কী! এযুগের ছেলে তো! ওর সম্পর্কে আমার একটু কৌতূহল বেশি হবার কারণ হলো, মজা পাই! সেদিন প্রধান অফিসে এসেছে শুনলাম, কিন্তু তার দেখা পেলাম না সারাটি দিন। হঠাৎ বিকালে চা-বিরতিতে দেখলাম পেছন ফিরে চা পান করছে। কী ব্যাপার অমুক বাবু কেমন আছেন? ‘স্যার ভালো আছি’ মুখ ফিরিয়েই উত্তর। মুখ ফিরে উত্তর দেওয়াতে একটু বিস্মিত হলেও কিছু বলি নি, গুরুত্বও দেই নি। পরে জানতে পারলাম, আমাদের এই বাঙালি বাবুটি সম্প্রতি ফ্রেন্চ-কাট নিয়েছেন তার দাড়িতে! হঠাৎ মুখমণ্ডলে এই পরিবর্তন আনার ফলে অফিসে ইতোমধ্যে অনেক হাসাহাসির সৃষ্টি হয়েছে। আসল ঘটনাটি ঘটলো সেদিন বিকেলে। মানে সন্ধায়। অপরিচিত নাম্বার দেখে সাথে সাথে কল রিসিভ করলাম। ওদিক থেকে ‘গুড নাইট’ বলে শুভেচ্ছা জানালেন আমাদের বাবুটি! কণ্ঠ বুঝতে না পেরে আমি আবার ‘হেলো’ বললাম। এবারও উত্তর এলো, গুড নাইট, স্যার। বলুন আমি এর কী উত্তর দেবো! এরপর যা বললো, তার সারমর্মটি হলো: সেদিন অফিসে সে ভালোভাবে কথা বলতে পারে নি, তার মুখে দাড়ি ছিলো এজন্য! দাড়ি রাখা তার কাছে একটি লজ্জার বিষয়!
.
শিক্ষিত সমাজে অনেকেই ‘গোসিপ’ শব্দটিকে বেশ আরামসে সব জায়গায় ব্যবহার করেন। তারা মনে করেন এর অর্থ হলো, আড্ডা দেওয়া বা গল্প করা। তাই নিজের সখ লেখতেও অনেকে গোসিপ বা গোসিপিং শব্দটি ব্যবহার করেন। এটি যে কত বড় ভুল, তা তারা জানেন না।
.
এরকম আরও অনেক ভুলই আছে, যা এমুহূর্তে মনে পড়ছে না সব। কিন্তু ভাষা যেহেতু বহমান নদীর মতো – ভাষার চেয়ে ‘ভাষীর’ গুরুত্ব বেশি। বহুল ব্যবহারের শক্তি দিয়ে ভুলই একসময় স্থায়ি হয়ে যায়। অভিধানে বিকল্প হিসেবে উল্লেখ করে ভুলকেই দেওয়া হবে অনুমোদন, যা পরবর্তি প্রজন্মের কাছে পুরোপুরি ব্যবহারযোগ্য হয়ে ওঠে।
.
.
________________________________________________________________________________________________
পরিশিষ্ট:
- সন্ধা বা রাতে প্রথম দেখায় সাক্ষাৎ হলে ‘গুড ইভনিং’ বলতে হয়। সন্ধা অথবা রাতে এমনটি বিকালেও বিদায় হলে, সেক্ষেত্রে ‘গুড নাইট’ বলা যায়।
- আড্ডা দেওয়া বা গল্প করা বলতে চাইলে ‘হ্যাং আউট’ বলা যায়। কিন্তু কখনও ‘গোসিপ/গোসিপিং’ বলা যায় না। গোসিপ বা গোসিপিং এর মানে খুবই নেতিবাচক, অর্থাৎ ‘কারও পেছনে বদনাম/দুর্নাম করা’ অথবা আড়ালে কথা বলা।
- দৈনন্দিন প্রয়োজনে ‘কেনাকাটা’ বুঝাতে শপিং বলা যায়, যদি ইংরেজি বলতেই হয়। ‘মার্কেটিং’ শব্দটি একেবারেই ভিন্ন অর্থ বহন করে। এর অর্থ হলো ব্যবসায়িক লাভের জন্য সেবা বা পণ্যের বাজারজাতকরণ।
মার্কেটিং তো আমিও ব্যবহার করি । কি লজ্জা । তবে কেনাকাটাই বেশি বলি ।
গুড নাইট এর বিষয়টা বেশ মজা দিল ।
LikeLike
হাহাহা, তাহলে আপনি পড়ে ফেলেছেন ‘লেদার’ কাহিনী।
ধন্যবাদ জেসমিন আপা!
আমরা কত ভুল করি না জেনে, তার কি ঠিক আছে?
তবে ভাষা যেহেতু বহমান, কোন ভুলই কালক্রমে ভুল থাকে না। তা ভাষা ব্যবহাকারীর পক্ষে চলে আসে।
অনেক শুভেচ্ছা 🙂
LikeLike