লোকসঙ্গীত সম্রাট আব্দুর রহমান বয়াতির ‘দেহঘড়ির’ অবসান
‘মন আমার দেহ ঘড়ি সন্ধান করি কোন মিস্তরি বানাইয়াছে’ গানটির অন্যতম পৃষ্ঠপোষক এবং বাংলা লোকসঙ্গীতের অন্যতম পুরোধা আব্দুর রহমান বয়াতির (৭৬) ‘দেহ ঘড়িটি’ বন্ধ হলো গতকাল (১৯ অগাস্ট) সকাল সাড়ে সাতটায়। যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাযা, চীন, অস্ট্রেলিয়া এবং জাপানসহ বিশ্বের প্রায় ৩২টি দেশে ভ্রমণ করে বাংলার লোকসঙ্গীতকে অবাঙালি বিশ্ববাসীর কাছে পরিচিত করিয়েছিলেন এই লোকসঙ্গীত শিল্পী। তার সঙ্গীত জীবনের উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো: জর্জ বুশের আমলে যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউজে লোকসঙ্গীত পরিবেশ করা। এছাড়া তিনি দেশের লোকসঙ্গীত শিল্পীদল নিয়ে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করেছেন।
‘গাড়ি চলে না চলে না’ বলে বিদায় নিয়েছিলেন বাউল সম্রাট শাহ আব্দুল করিম এবার ছিলো ‘দেহ ঘড়ির’ পালা! ‘আরও বাঁচতে চাই’ বলে বিদায় নিয়েছিলেন হুমায়ূন আহমেদ এবং হুমায়ুন আজাদ। মৃত্যুকে চ্যা্লেন্জ করলেই যে মৃত্যু এতো শিঘ্র চলে আসবে, তা কি তারা জানতেন? জানতেন না লোকসঙ্গীত সম্রাট আব্দুল রহমান বয়াতিও। মাসের পর মাস হাসপাতালে শুয়েও আবার ফিরে আসার স্বপ্ন দেখেছিলেন। বলেছিলেন, আরও গান গাইবার চাই! দেহতত্ত্ব আর ভাবতত্ত্ব দিয়ে যিনি জীবনের মানে খুঁজেছেন তার গানে আর দরাজ কণ্ঠে, সেই কণ্ঠ আর কারও জীবনতত্ত্বকে চ্যালেন্জ করবে না। ‘মানুষটা ছিলো খুবই উদাস’ – শিল্পী মমতাজের কথা। উদাস তো হবেনই, নিজের চাওয়া-পাওয়া সম্পর্কে সচেতন থেকে আরও যা-ই হোক শিল্পচর্চা হয় না।
.
আব্দুর রহমান বয়াতি সম্পর্কে কিছু গুরুত্বপূর্ণ তথ্য
পুরো নাম: আব্দুর রহমান বয়াতি
পারিবারিক ডাকনাম: বয়াতি
পারিবারিক তথ্য: স্ত্রী, ৩ পুত্র ও ৩ কন্যা
পিতা ও মাতা: মরহুম তোতা মিয়া ও মরিয়ম বেগম
জন্ম ও মৃত্যু: ১৯৩৯ (দয়াগঞ্জ, সূত্রাপুর, ঢাকা) – ১৯ অগাস্ট ২০১৩ (ঢাকা, জাপান বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল)
গায়ক জীবনের শুরু: ১৯৫৬
দলের নাম: আব্দুর রহমান বয়াতি দল (১৯৮২)
সঙ্গীতের প্রেরণা: প্রকৃতি ও মা
সঙ্গীত গুরু: কবি আলাউদ্দিন বয়াতি (কবি আলাউদ্দিন)। তিনিই ‘দেহঘড়ি’ গানটির গীতিকার।
অডিও এলবামের সংখ্যা: ৫০০
পুরস্কার: রাষ্ট্রপতি পুরস্কারসহ ৬টি জাতীয় পুরুস্কার
উল্লেখযোগ্য ঘটনা: যুক্তরাষ্ট্রের হোয়াইট হাউজে গান গাওয়া
বিশেষ এলবাম: ফিডব্যাক-এর ‘দেহঘড়ি’ (১৯৯৫) এলবামে তার দেহঘড়ির গানটি ফিউশন হয়
উল্লেখযোগ্য গানগুলো: ‘মন আমার দেহ ঘড়ি সন্ধান করি কোন মিস্তরি বানাইয়াছে’, ‘এই পৃথিবী যেমন আছে, তেমনি পড়ে রবে, সুন্দর এই পৃথিবী ছেড়ে চলে যেতে হবে’, ‘দিন গেলে আর দিন পাবি না’
সঙ্গীত প্রচারের মাধ্যম: প্রধানত তিনি মঞ্চ শিল্পী। তাছাড়া বাংলাদেশ বেতার, বাংলাদেশ টেলিভিশন এবং প্রাইভেট টিভি চ্যানেলে তিনি সঙ্গীত পরিবেশন করেছেন। ‘অসতী’ (১৯৮৯) নামে হাফিজুদ্দিন পরিচালিত একটি সিনেমাতেও তিনি গান গেয়েছেন।
.
শেষ জীবনে আব্দুর রহমান বয়াতি
এতো সুনামের অধিকারী হয়েও এবং দেশের লোকসঙ্গীত শিল্পকে এমনভাবে সমৃদ্ধ করেও এই মহান শিল্পী শেষ জীবনে চিকিৎসার জন্য অন্যের কাছে হাত পাততে হয়েছে। শেষ জীবনে দৈনিক ১৫০০ টাকায় গান গেয়েও সংসার চালানো কঠিন হয়ে পড়েছিলো তার। ফুসফুস, কিডনি এবং স্নায়ু সমস্যায় আক্রান্ত হয়ে কয়েক মাস পূর্বেই তিনি জাপান বাংলাদেশ হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন। অর্থের অভাবে প্রয়োজনীয় চিকিৎসা দেওয়া সম্ভব হয় নি। মৃত্যুর পুর্ব পর্যন্ত জাপান বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতাল তার ঔষধ ও চিকিৎসার খরচ বহন করে। ‘আমি আবার ভালো হইবার চাই, আমি আবারও গান গাইবার চাই’ বলে তিনি আকুতি প্রকাশ করেছিলেন উপস্থিত সাংবাদিকদের কাছে।
বাঙালি জাতি সঙ্গীতপ্রিয় জাতি, সঙ্গীত তাদের রক্তে। ভারতেও যারা সঙ্গীতে শত বছরের খ্যাতি ধারণ করে আছেন, তাদের অধিকাংশই বাঙালি! আব্দুল আলিম, আলাউদ্দিন, শাহ আব্দুল করিম বা আব্দুর রহমান বয়াতিদের গানে আমরা পাই শেখরের সন্ধান। জাতীয় পরিচয় পাই যে গানে, নিজেদের অস্তিত্বের সন্ধান পাই যাদের গানে, তারা একে একে চলে যাচ্ছেন আমাদের ছেড়ে। ক্রমেই যেন শেখড়-ছাড়া হয়ে যাচ্ছি আমরা!
.
কীভাবে শ্রদ্ধা জানাই!
শোকবার্তা বা একটি পোস্ট দিলেই শ্রদ্ধাপ্রদর্শন শেষ হয়ে যায় না। আমাদের উচিত তার সৃষ্টির প্রতি শ্রদ্ধাশীল হওয়া। পাইয়ারেটেড বা ইন্টারনেট থেকে গান ডাউনলোড না করে কম করে হলেও দোকান থেকে গানের এলবাম কেনা হতে পারে সর্বশ্রেষ্ঠ শ্রদ্ধা প্রদর্শন। সরকারের নির্দিষ্ট বিভাগের উচিত, অবিলম্বে আব্দুর রহমান বয়াতির সৃষ্টিকর্মের তত্ত্বাবধান করা। আগামির প্রজন্মের জন্য তার প্রতিটি সৃষ্টি, তার জীবনী ইত্যাদি সংরক্ষণ করা উচিত এখনই। যতই দেরি হবে, ততই কমতে থাকবে তার সৃষ্টকর্মের সংখ্যা ও পরিমাণ।
দেশের অস্তিত্ত্ব বহনকারী লোকসঙ্গীত শিল্পী আব্দুর রহমান বয়াতির প্রতি গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি !
_____________________________________________________________
তথ্যসূত্র:
ক. দৈনিক ইত্তেফাক ও বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম খ. স্বপ্নীল ডট কম গ. প্রিয় নিউজ ডট কম ঘ. ছবি ইন্টারনেট থেকে।
.
.
পরিশিষ্ট: পাঠকের জন্য অতিরিক্ত কিছু তথ্য
১) ইউটিউবে: মাটির একখান ঘর বানাইয়া মেশিন দিছে তার ভিতর…. মন আমার দেহঘড়ি সন্ধান করি
২) বিখ্যাত গানটির লিরিক: শিরোনামঃ মন আমার দেড় ঘড়ি, আব্দুর রহমান বয়াতী
একটি চাবি মাইরা দিলা ছাইড়া
জনম ভরি চলিতেছে।
মন আমার দেহ ঘড়ি সন্ধান করি
কোন মিস্ত্ররী বানাইয়াছে।
থাকের একটা কেস বানাইয়া মেশিন দিলো তার ভিতর
ওরে রং বেরংয়ের বার্নিশ করা দেখতে ঘড়ি কি সুন্দর।
ঘড়ির তিন পাটে তে গড়ন সারা
এই বয়লারের মেশিনের গড়া।
তিনশ ষাটটি ইশকুররম মারা ষোলজন পাহারা আছে।
ঘড়ি হেয়ার স্প্রিং ফ্যাপসা কেচিং লিভার হইলো কলিজায়
আর ছয়টি বলে
আজব কলে দিবানিশি প্রেম খেলায়।
ঘড়ি তিন কাটা বার জুয়েলে মিনিট কাটা হইলো দিলে
ঘন্টার কাটা হয় আক্কেলে
মনটারে সেকেন্ডে দিসে।
ঘড়ির কেসটা বত্রিশ চাকের, কলে কব্জা বেসুমার
দুইশো ছয়টা হাড়ের জোড়া, বাহাত্তর হাজারও তার।
ও মন, দেহঘড়ি চৌদ্দতলা, তার ভিতরে দশটি নালা,
একটা বন্ধ নয়টা খোলা গোপনে এক তালা আছে।
ঘড়ি দেখতে যদি হয় বাসনা
চলে যান ঘড়ির কাছে,
যার ঘড়ি সে তৈয়ার করে ঘড়ির ভিতর লুকাইছে,
ঘড়ির ভিতর লুকাইছে।
পর্দারও সত্তর হাজারে
তার ভিতলে লড়ে চড়ে
জ্ঞান নয়ন ফুটলে পরে দেখতে পারবেন চোখের কাছে।
ওস্তাদ আলাউদ্দিনে ভেবে বলছেন,
ওরে আমার মনবোকা,
বাউল রহমান মিয়ার কর্মদোষে হইল না ঘড়ির দেখা।
আমি যদি ঘড়ি চিনতে পারতাম,
ঘড়ির জুয়েল বদলাইতাম,
ঘড়ির জুয়েল বদলাইবো
কেমন যাই মিস্ত্ররীর কাছে?
মন আমার দেহঘড়ি
সন্ধান করি, কোন মিস্ত্রী বানাইছে।
মন আমার দেহঘড়ি
একটি চাবি মাইরা দিলা ছাইড়া
জনম ভরি চলিতেছে।
মন আমার দেহ ঘড়ি সন্ধান করি
কোন মিস্ত্ররী বানাইয়াছে।
৩) প্রধানমন্ত্রী এবং বিরোধীদলীয় নেত্রী ইতোমধ্যেই শ্রদ্ধাসহ শোকবার্তা পাঠিয়েছেন। দেশের সঙ্গীত ও শিল্পাঙ্গনের অনেকেই গিয়ে হাজির হয়েছেন জাপান-বাংলাদেশ মৈত্রী হাসপাতালে!
৪) আরও জানতে ভিজিট করুন:
http://www.gulf-times.com/bangladesh/245/details/363188/top-bangladeshi-folk-singer-dead
www.shopnil.com/home/meet-bangladesh/biography/302-abdur-rahman-boyati
www.news.priyo.com/entertainment/2011/07/01/folk-maestro-fights-life-appea-30397.html
http://www.thedailystar.net/beta2/news/abdur-rahman-boyati-no-more/
.
৫) দেশের এই স্বনামধন্য লোকসঙ্গীত সম্রাটকে কীভাবে শ্রদ্ধা জানাবো? আমি ভেবেছি ইন্টারনেট থেকে তার গানগুলো ডাউনলোড করার পরিবর্তে বাজারে গিয়ে তার কয়েকটি এলবাম কিনবো। পাঠকও ভেবে দেখতে পারেন!
___________________________________________________________________