চিঠিলেখা আয়োজনে প্রাকনির্বাচনী বক্তব্য ৩: সাহিত্য প্রতিযোগিতা আয়োজনের কতগুলো নির্দেশনা
চিঠিলেখা আয়োজনে প্রাকনির্বাচনী বক্তব্য ২: সাহিত্য মূল্যায়নের সমস্যাগুলো
ভবিষ্যত আয়োজনে যা করা যেতে পারে:
আয়োজকদের আন্তরিকতায় কোন কমতি নেই, একথা নিশ্চিতে বলা যায়। কর্তব্যনিষ্ঠারও কমতি দেখি নি। যার যার কর্মজীবনের মধ্যে থেকে এর চেয়ে বেশি আশা করা যায় না। এজন্য প্রথমেই নিঃশর্ত সাধুবাদ জানাই। শুধু প্রসঙ্গ এসেছে বলে কিছু মতামত রেখে যেতে চাই ভবিষ্যতের জন্য। নির্বাচক হিসেবে শত অযোগ্যতা নিয়েও ব্যক্তিগত দায় থেকেই কিছু বলছি। আমার মতে, ব্লগ যেহেতু একটি পাবলিক প্লেইস, সেখানে উপযুক্ত পরিকল্পনা করেই মাঠে নামা উচিত। এখানে নানা মুণির নানা মত – অথচ সকল মুণিকেই একই ছাতার নিচে রাখা চাই। অন্তত একটি নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত। এজন্য চাই যথেষ্ট পরিকল্পনা, হোমওয়ার্ক ও দূরদর্শিতা। খুঁটিনাটি বিষয়গুলো প্রথম পোস্টেই জানিয়ে দিলে ভবিষ্যতে আরও ভালো প্রতিযোগিতার আয়োজন হতে পারে প্রথম আলো ব্লগে। প্রথম বিজ্ঞপ্তিটি প্রকাশ হবার পূর্বে কমপক্ষে ১০টি পর্যায় অতিক্রম করা উচিত। লেখা মূল্যায়নের সহজ কিছু নির্দেশক বা পরিমাপক পূর্বেই প্রকাশ করলে সকল শ্রেণীর লেখকদের জন্য সমান সুযোগ সৃষ্টি হবে। তাছাড়া, সঞ্চালক বা ব্লগ কর্তৃপক্ষকে উপযুক্তভাবে সম্পৃক্ত করতে হবে – এর বিকল্প নেই।
.
[বিস্তারিত নিম্নে উল্লেখ করা হয়েছে]
সাহিত্য প্রতিযোগিতা যে কোন জনসংশ্লিষ্ট কোন আয়োজনের জন্য একটি চেকলিস্ট থাকলে একদৃষ্টে বুঝা যায় কী করা হলো, আর কী করা হলো না। ‘Forming-Storming-Performing’ নীতির আলোকে তৈরিকৃত নিম্নের চেকলিস্টটি কোন চূড়ান্ত বিধি নয় – এ নিয়ে আলোচনা হতে পারে, যোগবিয়োগও হতে পারে। তবু তালিকাটি একটি ভালো আয়োজনের জন্য চিন্তার খোরাক যোগাতে পারে:
• প্রস্তুতি/আহ্বায়ক কমিটি গঠন
• লেখার বিষয় নির্ধারণ
• লেখার মাধ্যম নির্ধারণ
• প্রকাশনার মাধ্যম নির্ধারণ
• কর্তৃপক্ষ/সঞ্চালক প্যানেলের সাথে আলোচনা
• নির্বাচক কমিটি গঠনের বিজ্ঞপ্তি
• নির্বাচক কমিটি গঠন
• লেখক/অংশগ্রহণকারীদের জন্য সমতল পরিবেশ নিশ্চিতকরণ
• লেখা মূল্যায়নের নির্দেশক নির্ধারণ
• স্বীকৃতি/সম্মাননা প্রদানের মাধ্যম নির্ধারণ
• অংশগ্রহণের বিজ্ঞপ্তি
• লেখা সংগ্রহ ও মূল্যায়ন
• বিশেষ অতিথি ও বিশেষ স্থান
• যথাসময়ে ফলাফল বা স্বীকৃতি প্রদানের অনুষ্ঠান
কিছু বর্ণনা দেবার চেষ্টা করলাম:
I. প্রস্তুতি/আহ্বায়ক কমিটি গঠন: একটি প্রস্তুতি কমিটি গঠন করা যেতে পারে যারা নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে ১ থেকে ৫ পর্যন্ত কাজগুলোর দেখাশুনা করবেন।
II. লেখার বিষয় নির্ধারণ: ‘কী বিষয়ে লেখতে হবে’ সেটা নির্ধারণ করতে হবে – স্মৃতিচারণ, স্বদেশ, মুক্তিযুদ্ধ, বর্ষাকাল ইত্যাদি যা-হোক আগে সুস্পষ্ট করতে হবে।
III. লেখার মাধ্যম নির্ধারণ: কবিতা, প্রবন্ধ, ছোটগল্প, ছড়া নাকি স্মৃতিকথা? ফরম্যাট ঠিক করা থাকলে সকল প্রতিযোগী একই মনোভাব নিয়ে অগ্রসর হবেন।
IV. প্রকাশনার মাধ্যম নির্ধারণ: জমাকৃত লেখাগুলো কীভাবে প্রকাশ পাবে- পিডিএফ নাকি ছাপানো, ছাপানো হলে কী সাইজের ইত্যাদি। এখানে প্রকাশক বা সম্পাদকের তথ্য দেওয়া থাকলে আরও ভালো।
V. সঞ্চালক প্যানেলের সাথে আলোচনা: সঞ্চালক বা ব্লগ কর্তৃপক্ষের সাথে নিয়মিত যোগাযোগ করে তাদের সহযোগিতা নিশ্চিত করতে হবে। প্রতিযোগিতাটি ব্লগ কর্তৃপক্ষের নীতিমালার সাথে মানানসই কিনা তাও দেখতে হবে।
VI. নির্বাচক কমিটি গঠনের বিজ্ঞপ্তি: নির্বাচক কমিটিতে যারা আসবেন তারা কিসের ভিত্তিতে নির্বাচিত হচ্ছেন সেটা আগেই প্রচার করা উচিত। যেমন, সময় বা লেখার সংখ্যার বিচারে তাদের জৈষ্ঠ্যতা, পাঠকের/সহব্লগারদের গ্রহণযোগ্যতা, পাঠকের মন্তব্যের ভিত্তিতে জৈষ্ঠ্যতা, লেখার মানের ভিত্তিতেও হতে পারে। এসব বিষয়গুলো পূর্বেই ব্লগে প্রকাশ করলে প্রতিযোগিতার বিষয়ে গ্রহণযোগ্যতা বাড়বে।
VII. নির্বাচক কমিটি গঠন: বিভিন্ন পর্যায়ের ব্লগার এবং সঞ্চালক কমিটির সদস্যদের সমন্বয়ে একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচক কমিটি গঠন করে ঘোষণা দিতে হবে। সাক্ষাতে সভা করা অসম্ভব হলে, গ্রুপচ্যাটিং ইত্যাদি করে ভারচুয়াল সভা করা যেতে পারে।
VIII. লেখক/অংশগ্রহণকারীদের জন্য সমতল পরিবেশ নিশ্চিতকরণ: উপরোক্ত শর্তগুলো অতিক্রম করলে স্বাভাবিকভাবেই সকলের অংশগ্রহণের সমান সুযোগ সৃষ্টি হবে। প্রেরণা পাবেন সকল পথের সকল মনের ব্লগারগণ।
IX. লেখা মূল্যায়নের নির্দেশক নির্ধারণ: প্রচলিত নির্দেশকগুলো হতে পারে এরকম – ক) ভাষা (শুদ্ধ বানান, সাধু ও চলিত ভাষার অবিমিশ্রিত ব্যবহার), খ) লেখার বিষয় (লেখাটি কি সময়ের প্রতিনিধিত্ব করছে, নাকি ইতিহাসের সাক্ষী হচ্ছে নাকি বিনোদন দিচ্ছে ইত্যাদি), গ) লেখার আকৃতি (কত শব্দের, কত পৃষ্ঠার, কোন্ কী বোর্ড ইত্যাদি), ঘ) কী কী বিষয়ে লেখা যাবে না, তাও উল্লেখ করে দেওয়া যায়।
X. স্বীকৃতি/সম্মানতা প্রদানের মাধ্যম নির্ধারণ: শ্রেষ্ঠ যদি সত্যিই শ্রেষ্ঠ হয়, তবে তাকে স্বীকৃতি দিতে কোন বাধা থাকে না। স্বীকৃতি যদি সঠিক ভিত্তির ওপরে স্থাপিত হয়, তবে কী দিয়ে তা প্রদান করা হলো, সেটি খুব বিবেচ্য নয়। তবে যা-ই হোক, সেটা ঘোষণা থাকা ভালো। শুধু একটি সনদপত্র/ক্রেস্ট দিয়েও স্বীকৃতি হতে পারে। হতে পারে একটি সুন্দর বই।
XI. অংশগ্রহণের বিজ্ঞপ্তি: উপরোক্ত ১০টি পর্যায় অতিক্রম করার পর নির্দ্বিধায় বিজ্ঞপ্তি প্রদান করা যায়। বিজ্ঞপ্তি যত দীর্ঘই হোক সেটা সংশ্লিষ্টরা অবশ্যই পড়বেন। তাই লেখার দৈর্ঘ নিয়ে চিন্তিত না হয়ে পরিপূর্ণতার দিকে খেয়াল দিতে হবে।
XII. লেখা সংগ্রহ ও মূল্যায়ন: প্রথমত অংশগ্রহণকারী সকল প্রতিযোগীর নাম ও লেখা তালিকাভূক্ত করতে হবে। কেউ যেন বাদ না পড়েন! অযোগ্যতা থাকলে তা আলাদা মন্তব্যে উল্লেখ করা যায়, কিন্তু তালিকায় নাম অবশ্যই থাকা চাই। পূর্বঘোষিত মাপকাঠি/শর্তাবলীর আলোকে প্রতিটি লেখাকে মূল্যায়ন করে, ‘ডিমিনিশিং’ পদ্ধতিতে তালিকা ছোট (শর্টলিস্টিং) করে আনা যায়। তাতে সকলেই সুবিচার পাবেন।
XIII. বিশেষ অতিথি ও বিশেষ স্থান: সম্মাননা বা স্বীকৃতি প্রদানের জন্য একটি অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে প্রতিযোগিতার সফল সমাপ্তি ঘটাতে হবে। সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট বিশেষ অতিথি নির্বাচন করে তার উপস্থিতি নিশ্চিত করতে হবে। বিশেষ স্থান হলেও পূর্ব থেকেই সেটি নিশ্চিত করে রাখতে হবে। সম্মাননা অনুষ্ঠানের জন্য একটি আলাদা পোস্ট দেওয়া উত্তম। তবে খসড়া পরিকল্পনাটি প্রথম পোস্টেই প্রকাশ করা যায়।
XIV. যথাসময়ে ফলাফল বা স্বীকৃতি প্রদানের অনুষ্ঠান: এমনভাবে স্থান ও তারিখ নির্ধারণ করতে হবে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ ছাড়া যার কোন পরিবর্তন হবে না। যথাসময়ে এবং যথাস্থানে অনুষ্ঠান শুরু করতে হবে। ৬টার অনুষ্ঠান ৯টায় হলে, অনুষ্ঠানের মান এবং সম্মান দু’টোই কমে যায়।
শেষ কথা হলো, সকলকে ধন্যবাদ এবং শুভেচ্ছা!
কিছু সমস্যার কথা যোগ না করলে যেমন ‘প্রাপ্তির কথা’ বিশ্বাসযোগ্য হয় না, তেমনি কিছু পরামর্শ বা সুপারিশ না দিয়ে শুধু ‘সমস্যার কথা’ বলাও দায়িত্বহীনতা। এক্ষেত্রে ভারসাম্য রক্ষায় কতটুকু সফল হলাম, পাঠক বলতে পারবেন। আমি বিশ্বাস করি, ব্লগারের পরিচয় হলো তার লেখায়। কিন্তু সকলেই তো রবীন্দ্র-নজরুল-সুকান্ত-রৌদ্র নন যে, নিজের প্রেরণায় লেখে যাবেন একটির পর একটি মাস্টারপিস। অধিকাংশ ব্লগারের প্রয়োজন পর্যাপ্ত প্রণোদনা বা প্রেষণা। লেখালেখিতে ব্লগারদেরকে তৎপর রাখার জন্য কতৃপক্ষকেই উদ্যোগ নিতে হয়। তা না হলে দলাদলি, ফেইকনিক, মেরুকরণ, ব্যানকরণ, ব্লককরণ ইত্যাদি নেতিবাচক উপসর্গ দেখা দিতে শুরু করলে, অঙ্গুলি চলে যায় সঞ্চালকের দিকে। মাঝখানে পরে শান্তিপ্রিয় ব্লগাররা ভুল বুঝাবুঝির শিকার হন। ব্লগে ব্লগারদের কর্মচঞ্চলতা বাড়াতে বিভিন্ন আয়োজন নিয়মিত এবং নিরবচ্ছিন্নভাবে চলতে থাকুক, এই কামনা করছি। প্রিয়চিঠি আয়োজনে সংশ্লিষ্ট সকলকে শ্রদ্ধা ও শুভেচ্ছা জানাচ্ছি।
*প্রথম ছবি আলো ব্লগ থেকে নেওয়া, গ্রাফ-ছবিটি পোস্টদাতার তৈরি।
[ প্রথম আলো ব্লগে পাঠক প্রতিক্রিয়া ]
.
প্রথম আলো ব্লগে চিঠি লেখা আয়োজনের নির্বাচক হবার অভিজ্ঞতা।
.
এবিষয়ে পূর্বের পর্ব:
চিঠিলেখা আয়োজনে প্রাকনির্বাচনী বক্তব্য ২: সাহিত্য মূল্যায়নের সমস্যাগুলো