চিঠিলেখা আয়োজনে প্রাকনির্বাচনী বক্তব্য ২: সাহিত্য মূল্যায়নের সমস্যাগুলো
প্রাকনির্বাচনী বক্তব্য ১ ‘চিপায় পড়িয়ে যাহা হয়’
৫) চিঠির নির্বাচন-সংশ্লিষ্ট বক্তব্য
বিগত পোস্টে শুধুই প্রাপ্তির কথা বলেছি। ‘চিপায় পড়েছি’ বলেছি কেবলই মজা করার জন্য, যদিও সে সম্পর্কে কিছু বলা হয় নি। প্রিয় সহব্লগারগণ কেবল প্রাপ্তির বিষয় পড়ে আমার ‘চিপায় পড়া’ নিয়ে মজা করেছেন। আপনাদের মজায় পাওয়া দেখে আমিও মজা পেয়েছি। সবান্ধবে বিপদে পড়লেও সেটা হেসেখেলে অতিক্রম করা যায়। প্রাপ্তিই সেখানে বেশি। এবারও প্রাপ্তির কথাই বলবো – শুধু ভিন্ন আঙ্গিকে। যে কোন বিষয়েই বিচার অনেক কঠিন, কিন্তু সাহিত্যকর্মের বিচার করা সবচেয়ে কঠিন মনে হয়েছে। সাহিত্য রচনায় কোন বিশেষ শর্ত আরোপ করা যায় না বলে এর বিচার করা মোটামুটি জটিল। আমার মতে, সকল চিঠি নির্বাচকই এ জটিলতার মুখোমুখি হবেন। চিঠিলেখা আয়োজনে প্রত্যেক সম্মানীত লেখক অবারিত স্বাধীনতা নিয়েছেন তাদের চিঠি রচনার ক্ষেত্রে। স্বাধীনতা পরিমাপ না করা গেলেও তা কিন্তু অসীম নয়: একজনে বেশি পেলে অন্যজনের কম পড়ে। কয়েকটি কারণ তুলে ধরলাম, যাকে পুরোপুরি সমস্যাও বলা যায় না।
.
ক) পূর্ব থেকে কোন শর্তাবলী বা ক্রাইটেরিয়া নির্ধারণ করা হয় নি: আমার ধারণা, না করাটাই ভালো, তাতে সকল পর্যায়ের লেখক যোগ দিতে উৎসাহিত বোধ করেছেন। লেখার মানউন্নয়ন করতে হলে প্রচুর লেখা চাই। পুরস্কার বা স্বীকৃতিটাই বড় বিষয় নয়।
.
খ) কোন কাঠামো বা প্রাপক বা অডিয়েন্স নির্ধারিত হয় নি: এটি পূর্বোক্ত কারণেই হয় নি। শুধু প্রকৃতি বা আকাশকে নয়, ‘নিজের’ সমীপেও চিঠি লিখেছেন এবং তা ভালোও লেগেছে। চিঠির সম্বোধন, ভাষা বা বিষয়-বিন্যাস নিয়ে কোন দিকনির্দেশনা ছিলো না। অনেকটা ‘লিখুন আপনার মনে যাহা চায়’-এর মতো। এতে নির্বাচকের জন্য সমস্যা হলেও, লেখায় এসেছে বৈচিত্র।
.
গ) প্রতিযোগিতার জন্য হলেও লেখকরা পেয়েছেন সর্বোচ্চ স্বাধীনতা: কেউ কবিতার ভঙ্গিতে, কেউ গল্পের ভঙ্গিতে আবার কেউ বা মাঝামাঝি ভঙ্গিতে চিঠি লিখেছেন। অন্তত শব্দের সংখ্যাটি ঠিক করে দেওযা যেতো। কেউ ২০০ শব্দে, কেউবা ২০০০ শব্দে চিঠি লিখেছেন।
.
ঘ) বিচারক/গণপাঠক সমীপে: প্রেরক-প্রাপকের মধ্যে আর কেউ নেই, অর্থাৎ এ চিঠি আর কেউ পড়বে না, এরকম মানসিকতা নিয়ে লেখা চিঠির সংখ্যা কম। যার নাম চিঠির প্রাপকের স্থানে আছে, একদম তাকেই উদ্দেশ্য করে সকল বক্তব্য বলা হয় নি। প্রচ্ছন্নভাবে বক্তব্যের গন্তব্য বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে গেছে: অনেকটা গণচিঠির মতো। এতে কোন অনিয়ম হয় নি, কারণ নিয়মই তো নেই – নির্বাচকের জন্য এটিও একটি চ্যালেন্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
.
ঙ) সীমানা নির্ধারণ না থাকায় প্রত্যেকেই স্ব স্ব বিষয়ের আঙ্গিকে ভালো লিখেছেন: প্রতেকেরই এরকম দাবি করার অধিকার আছে যে, তার চিঠিটি উত্তম হয়েছে, কারণ প্রতেক্যের চিঠির বিষয়ই আলাদা এবং অন্যের সাথে অতুলনীয়। কেউ ধারে, কেউবা ভারে; কেউ কবিত্বে, কেউবা প্রকৃত চিঠি লেখার দক্ষতায়; কেউ ভাষাগতভাবে এগিয়ে আবার কেউবা বিষয়গত ভাবে এগিয়ে। বিচারক এবার যাবেন কোথায়!
.
চ) নির্বাচক কমিটির বিচ্ছিন্নতা: কমিটি হলেই সেখানে মিটিং হবে, আলোচনা হবে, আর হবে সিদ্ধান্ত। এটিই সাধারণ রীতি। কিন্তু ব্লগারদের বেলায় সেটি সম্ভব হচ্ছে না, আমরা একেক জন একেক দিগন্তে বাস করি।
.
এসবের মধ্যেও কিন্তু নির্বাচক হিসেবে একটি চিঠি বের করতেই হবে। কেবলই একটি চিঠি। আমি তো কমপক্ষে ২০টি চিঠি পেয়েছি, যার প্রত্যেকটি স্ব স্ব ক্ষেত্রে উত্তম! কিন্তু বের করতে হবে একটি চিঠি – সেটি কার হবে? শত কর্মব্যস্ততার মাঝেও এটি আমার কাছে সবচেয়ে জটিল এবং গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।
.
৬) লেখকের ‘স্বাধীনতার’ একটুস খানি নির্বাচককে দেওয়া যায় না!?
আমাকে যদি বলা হতো ২০টি উত্তম চিঠি বের করতে হবে, তবে তা-ই করতে পারতাম। কিছু চিঠি সত্যিই বিশেষ স্থানে ওঠে এসেছে। চেতনা ও অনুভূতির শীর্ষে এসে কয়েকটি চিঠি এসে কঠিন প্রতিযোগিতায় অবতীর্ণ হয়েছে। সৃষ্টি করেছে নির্বাচকের মনে পীড়াদায়ক দ্বন্দ্ব। বিবেকের কাছে স্বচ্ছ থাকতে চাইলে এটি যেন নির্বাচকের জন্য এক অগ্নিপরীক্ষা! অনেক উত্তমের মধ্যে একটিকে বেছে নিতে হবে। একটি চিঠিই নির্বাচন করতে হবে। অতএব পিঠে চট বেঁধেছি, ইচ্ছেমত সমালোচনা করুন নির্বাচকের। যারা সরাসরি করবেন না, মনে মনে করবেন, তাদের জন্য বার্তা কক্ষ খোলা থাকলো। সমালোচনা করার যথার্থ কারণ যেহেতু আছে, তাই অগ্রিম ক্ষমা প্রার্থনা করছি। শেষ চেষ্টা হিসেবে বলে নিচ্ছি: লেখকেরা যেহেতু অবাধ স্বাধীনতা পেয়েছেন, নির্বাচকদেরকে সেখান থেকে একটুখানি স্বাধীনতা বরাদ্দ দিন, তাহলেই বর্তে যাই!
.
৭) সহব্লগারদের কাছে আগাম অনুরোধ:
চিঠিলেখা আয়োজনের কারণে একটি নির্দিষ্ট সময় ব্লগে থাকতেই হয়েছে। কর্মজীবন এবং সংসার ধর্ম করেও নিয়মিত ব্লগে থেকে সহব্লগারদের হৃদয়-নিংড়ানো লেখাগুলোতে দৃষ্টি দেওয়াকে একটি পবিত্র দায়িত্ব মনে করেছি। জানি না নির্বাচক হিসেবে কতটুকু দায় পালন করতে পারলাম। তবে আমার কাজ প্রায় শেষ বলেই আমি মনে করি। এখন কাজ শুধু একটি চিঠিকে নির্বাচন করে ঘোষণা দেওয়া। অনেক কঠিন হলেও তা আমাকে করতেই হবে। সকল সহব্লগারের কাছে বিনীত অনুরোধ: যেহেতু আয়োজক এবং অংশগ্রহণকারী সকলেই এখানে স্বেচ্ছাসেবী, চলুন একে অন্যকে গ্রহণ করি আন্তরিকতা দিয়ে। সিদ্ধান্ত যা-ই হোক, মানবিকতাবোধ এবং নিজস্ব রুচিবোধকে তুলে ধরি। এ ধরণের প্রতিযোগিতাগুলোতে মানুষের মূল্যবোধগুলো সবচেয়ে বেশি পরীক্ষিত হয়।
.
৮) ভবিষ্যত আয়োজনে যা করা যেতে পারে:
সমস্যা উত্থাপন করলে কিছু সমাধানের প্রস্তাবও দিতে হয়। ২০১৩ সালের চিঠিলেখা আয়োজনে যুক্ত থেকে লেখা প্রতিযোগিতা সম্পর্কে আমার কিছু মতামত জড়ো হয়েছে। ছাত্রজীবনে, এমনকি কর্মজীবনেও, এরকমের কিছু কিছু আয়োজন করতে হয়েছে। অচেনা এলাকার বৈরি জনতা, সরকারি কর্মকর্তা, বেসরকারি প্রতিনিধি, স্থানীয় জনপ্রতিনিধি সকল পর্যায়ের লোকদেরকে নিয়ে এমন কিছু কর্মসূচি বাস্তবায়ন করতে হয়েছে, যা ব্যর্থ হলে জুতা পড়ার সময় পাওয়া যেতো না! সেসব অভিজ্ঞতা থেকে শেষ পোস্টে প্রাসঙ্গিক কিছু বিষয় তুলে ধরতে চাই। শুধুই চিন্তায় খোরাক যোগাবার জন্য।
[প্রথম আলো ব্লগে পাঠক প্রতিক্রিয়া]
.
.
** প্রথম আলো ব্লগে চিঠি লেখা আয়োজনের নির্বাচক হবার অভিজ্ঞতা।
এবিষয়ে পূর্বের পর্ব: প্রাকনির্বাচনী বক্তব্য ১ ‘চিপায় পড়িয়ে যাহা হয়’