পোশাক শ্রমিকের অধিকার: বিজিমিয়া আসলে করে কী?
বিজিমিয়া আসলে কার সেবা করে?
সমস্যা এলেই এর তাৎক্ষণিক সমাধান চাই আমরা – সাথে জানতে চাই এর সূত্রপাত কোথায়। সবচেয়ে বেশি চাই, দায়িত্বশীল ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানটিকে সনাক্ত করতে। তাজরিন ট্রাজিডি, সাভার ট্রাজিডি, অগ্নিসংযোগ আর অন্তহীন শ্রমিক বিদ্রোহের ঘটনায় বার বার একটি প্রতিষ্ঠানের দিকে দৃষ্টি চলে যায়। একটি আঠারো-তলা ভবনের দিকে অসহায় মানুষের প্রশ্নগুলো গিয়ে জমা হয়। তারা আসলে কী করছে সেখানে? দেশের পোশাকশিল্পে তাদের কোনই নিয়ন্ত্রণ নেই? প্রতিষ্ঠানটি আসলে কিসের উদ্দেশ্য গড়ে ওঠেছে? অথচ দেশের পোশাকশিল্পকে যথাযথ দিকনির্দেশনা দিয়ে প্রগতির দিকে পরিচালনা দেবার লক্ষে প্রতিষ্ঠানটি গড়ে ওঠেছিলো। বিজিএমইএকে বাংলা কথাবার্তায় ‘বিজিমিয়ার’ মতো শুনায়, যেমন ডিওএইচএসকে ‘ডিএস’ বলেন আমাদের রিকসাড্রাইভার ভাইয়েরা। বিজিমিয়া বিজি ফর নাথিং?
কাগজে-কলমে বিজিমিয়ার উদ্দেশ্য
বিজিএমইএ’র মৌলিক উদ্দেশ্য হলো উৎপাদনকারী, রপ্তানীকারক এবং আমদানীকারকদের মধ্যে আন্তরিকতা এবং পাস্পরিকভাবে অনুকূল সম্পর্কের জন্য, এবং দেশের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন বৃদ্ধির জন্য একটি সুষম বাণিজ্যিক পরিবেশ প্রতিষ্ঠা করা। এটি বিজিএমইএ’র হোমপেইজে তারা নিজেরাই ঘোষণা করেছে। তাদের অনেক উদ্দেশ্যের মধ্যে প্রথম তিনটি উদ্দেশ্য হলো ১) সরকারি নীতিমালার প্রয়োগের মাধ্যমে পোশাকশিল্পের স্বার্থ রক্ষা এবং এ সেক্টরের সুষম অগ্রগতি সাধন করা; ২) গার্মেন্টস কর্মীদেরকে আইনসংগত সুবিধাদি এবং তাদের অধিকার বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে বিজিএমইএ সদস্য এবং তাদের কর্মীদের স্বার্থ রক্ষা করা; ৩) বিদেশী এবং স্থানীয় পর্যায়ের ক্রেতা-প্রতিনিধির সাথে পরামর্শ ও আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে পোশাকশিল্পের অগ্রগতি সাধন করা। বিজিএমইএ’র প্রধান একটি দায়িত্ব হলো এক্সপোর্ট অর্ডারের ভিত্তিতে কাপড়, সূতা, রঙ, পশমি সূতা ইত্যাদির পরিমাণ নির্ধারণ করে সদস্য কারখানার জন্য ইউডি (ইউটিলাইজেশন ডিক্লেয়ারেশন) ইস্যু করা। পোশাক কারখানাকে শিশুশ্রম মুক্ত করা বিজিএমইএ’র ‘ঈমানি দায়িত্ব’, কারণ তা না হলে স্বাক্ষরিত আন্তর্জাতিক স্মারকের বরখেলাপ হবে। বলা বাহুল্য ঈমানি দায়িত্বটিও যথাযথভাবে পালন করে নি আমাদের বিজিমিয়া, অর্থাৎ বিজিএমইএ – ফলে, চিরতরে বাজার-হারা!
বিজিমিয়ার জামিতিক গতিতে উন্নয়ন আর গরিবের হাতে মূলা
১৯৭৭ সালে মাত্র ১২টি পোশাক তৈরির কারখানাকে সদস্যপদ দিয়ে বিজিএমইএ’র যাত্রা শুরু। স্বল্পমূল্যে, অনেকে বলছে বিনামূল্যে, শ্রম পাওয়া যায় ঘণবসতির এ বাংলাদেশে। ফলে, বছরের পর বছর লাভ বেড়েছে, কারখানার সংখ্যা বেড়েছে, সেসাথে বেড়েছে কর্মীর সংখ্যা।
পোশাক শিল্পকে সুবিধা দেবার ক্ষেত্রে দেশের সরকারগুলো যেন প্রতিযোগিতায় নেমেছিলো। কী পায় নি তারা? কর অবকাশ বা ট্যাক্স হলিডে তো নিয়মিতই পাচ্ছে। এযাবত নগদ প্রণোদনা বা ক্যাশ ইনসেনটিভ হিসেবে পেয়েছে প্রায় দশ হাজার কোটি টাকা। ইউরোপ বা পশ্চিমা দেশ থেকে শুল্ক অব্যাহতি পাবার লক্ষে জিএসপি সুবিধা পাবার জন্য সরকারের সর্বোচ্চ প্রভাবকে তারা ব্যবহার করেছে প্রায় সব দলের আমলেই। শুধু ২০১১-২০১২ সালে তৈরি পোশাক থেকে ১৯ বিলিয়ন আয় হয় যা মোট বৈদেশিক আয়ের ৭৮%।
অধিক শ্রমিকের যোগান আর গরিবের পেটে লাথি
বর্তমানে প্রায় ৪০ লাখ কর্মীর ৮০% নারী কর্মী যারা প্রথাগতভাবেই কণ্ঠ উচ্চে তুলতে পারে না। সঙ্গত কারণেই তাদের নিয়ে কাজ করতে সুবিধা বেশি। ফলে নারী কর্মীর কর্মসংস্থানে অল্প প্রচেষ্টাতেই তা দেশের অর্থনীতিতে ইতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। এভাবে পোশাকশিল্পে নারীর নির্ভরশীলতা বেড়েছে। অংশগ্রহণও বেড়েছে। অভাবের তাড়নায় গ্রাম থেকে পালানো কিশোরী মেয়েদের একমাত্র আশ্রয় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি। বানের পানিতে ভাসা কচুরিপানার মতো শহর ও উপশহরগুলোতে কর্মহীন কিশোর-কিশোরিদের ভিড় বাড়তে লাগলো। বাড়তে লাগলো অযাযিত শ্রমের যোগান। যোগান বেশি হলে চাহিদা কম, তাই শ্রমের দামও কম। কিন্তু শ্রমিকের পক্ষে তো অর্থনীতির মারপেঁচ মোতাবেক আচরণ করা সম্ভব নয়। তাদেরকে কাজ করতেই হবে – অন্তত পেটের ভাত তো জুটবে! এসুবিধাকে কাজে লাগাবে না এরকম নীতিবান ব্যবসায়ী কি আশা করা যায়?
শ্রমিকের অধিকার: ব্যবসায়ী না শুনে নীতির কাহিনি
বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সময়ে ন্যূনতম বেতন নিয়ে বেশ জোড়ালো দাবি ওঠলো। পোশাক কারখানার পরিবেশ নিয়ে বিদেশী ক্রেতারা মিহিসুরে কিছু অভিযোগ করেই খেমতা দেন, কারণ এর চেয়ে বেশি বললেই ঝামেলা গিয়ে পড়বে এলসি’র ওপর। তাহলে বাকি থাকলো কে? আমাদের সুশীল সমাজ, যাদেরকে অনেকে ভিন্ন নামে চেনে। তাদের আওয়াজের সাথে রাষ্ট্রীয় কোন সহযোগিতা না থাকায় ওটা আওয়াজ পর্যন্তই থেকে যায়। মুখচেনা কিছু শ্রমিক নেতাকে ডেকে এনে একটি সাংবাদিক সম্মেলন করলেই কেল্লা ফতে! গার্মেন্টস মালিকদের কীইবা করার আছে বলুন? এতো কিছুর পরও তো তাদের শ্রমিকের অভাব হচ্ছে না। তারা কি দেশের নারীসমাজকে কর্ম দিয়ে দেশকে উদ্ধার করে দিয়েছে না? তাজরিন ফ্যাশনে অগ্নিকাণ্ডে যখন ১১২ শ্রমিক মারা গেলো তখন তাৎক্ষণিকভাবে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়, কারণ কমিটি বললে এখন আর কেউ বিশ্বাস করে না। যা হোক, ওই টাস্কফোর্স এসে সাংবাদিকদের বললো অবিলম্বে তারা দেশের পোশাককারখানা পরিদর্শন করবে। একটি কারখানা পরিদর্শনের পর, হোই পর্যন্তই উহা শেষ!
এবার ভবনধসে মারা গেলো ৪০৫ শ্রমিক, তাই বেশি কিছু করতে হবে। তারা পুরস্কার ঘোষণা করলো, যারা ভবনমালিক সোহেল রানাকে ধরিয়ে দিতে পারবে তাদেরকে ৫লাখ টাকা পুরস্কার দেওয়া হবে। একজন সাবেক বিজিমিয়া বললেন, “ভাই এবারের ঘটনা ভিন্ন। সত্যিই আমাদের ভাবিয়ে তোলেছে।” এভাবে কিছুদিন মিডিয়ার সামনে তারা ঢাকঢোল পেটাবে। তারপর যেই লাউ সেই কদু!
দুধকলা খাইয়ে……
পৃথিবীর অন্য কোন দেশে কোন ব্যক্তিমালিকানাধীন শিল্পকে দেশের সরকার এতো সুবিধা দেয় নি। সরকারি ভর্তুকি, তাও নগদ অর্থে, কোন দেশে এরকম আছে কিনা জানা নেই। সুবিধা আর আস্কারা দেবার নিকৃষ্ট প্রমাণ হলো হাতিরঝিলের ওপর বিজিমিয়ার অবৈধ ১৮ তলা ভবন। বেআইনিভাবে সরকারি জমিতে গড়ে তোলা ভবনটিকে ভেঙ্গে ফেলার হুকুম আসলেও বিভিন্ন কায়দা-কানুন করে তারা স্থগিতাদেশ বের করেছে। এই হলো বিজিমিয়ার নীতি প্রতি শ্রদ্ধার নমুনা।
অতএব ভবনধসের পর অগ্নিকাণ্ড আবার অগ্নিকাণ্ডের ভবনধস এভাবে চলতেই থাকবে। খেয়াল রাখতে হবে, বিজিমিয়া হলো একটি গার্মেন্টস মালিক এসোসিয়েশন। যে দেশে ট্রেড ইউনিয়নের কার্যকারিতা নেই, নেই শ্রমিক সংগঠনের স্থায়ি কোন অস্তিত্ব, সে দেশে বিভিন্ন শিল্পের মালিকদের এসোসিয়েশনে ভরপুর। অতএব বিজিমিয়া বিজি আছেন তাদের নিজেদের অস্তিত্ব নিয়ে আর কীভাবে অধিক লাভ করা যায়। শ্রমিকের ন্যূনতম বেতন বা কর্মস্থলে স্বাস্থ্যকর পরিবেশ দিলে কি লাভ থাকবে? জাতির কাছে এই প্রশ্ন রেখে শেষ করলাম।
*পাদটীকা: পরিস্থিতির উন্নয়ন না হলে পোশাকশিল্প ধ্বংস হবে শিঘ্রই। ইউরোপিয়ান কমিশন সম্প্রতি সাবধান করে দিয়েছে। হ্রাসকৃত বা বিনা শুল্কে ইউরোপে পোশাক রপ্তানি করার সুবিধা হারাবার সমূহ সম্ভাবনা। পরিস্থিতির দ্রুত উন্নয়ন না হলে জেনারেলাইজড সিস্টেম অভ প্রেফারেন্স বা জিএসপি সুবিধা কেড়ে নেবার হুমকি দিয়ে তারা।
**তথ্যসূত্র:
1) http://www.banglapedia.org/HT/B_0439.HTM
2) http://www.prothom-alo.com/detail/date/2013-04-30/news/348863
3) http://www.bgmea.com.bd/home/pages/aboutus#.UYKBEaL-E-Q
4) http://www.thedailystar.net/beta2/news/bgmea-and-image-crisis/
কাজ করাইয়া টাকা না দেয়াদের সংগঠন বিজিময়া !
হা হা হা হা হা হা
LikeLiked by 1 person
স্বার্থপর পুজিবাদিদের সিন্ডিকেট। ধন্যবাদ 🙂
LikeLiked by 1 person