চিন্তা-চেতনা নিজ দায়িত্বে রাখুন!
১. সময়টা একটু কঠিনই হয়ে এসেছে। ‘মালামাল নিজ দায়িত্বে রাখুন’ বলার চেয়ে ‘যার যার চিন্তাচেতনা নিজ দায়িত্বে রাখুন’ বলাই এখন যুক্তিযুক্ত। নিজের চিন্তা অন্যের ওপর চাপিয়ে দেওয়ার জন্যই যত সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে। পরিবার ও সমাজ থেকে রাষ্ট্র পর্যন্ত এ চর্চা চলছে। সন্তানের দক্ষতা ও ঝোঁক বিবেচনায় না এনে মা-বাবারা এনজিনিয়ার হবার চাপ দিচ্ছেন। অন্যদিকে জনগণের সমস্যা ও তাদের চাওয়া-পাওয়াকে চিন্তা না করেই রাজনীতিবিদেরা নিজ নিজ দলীয় লক্ষ্যমাত্রাকে জনগণের বলে চালিয়ে দিচ্ছেন। এমন পরিস্থিতিতে আমজনতার কী অবস্থা হতে পারে সহজেই ঠাওর করা যায়। তথাকথিত উন্নয়নসহযোগীরাও একই কায়দায় আমাদের ওপর চড়াও হয়েছে।
উন্নত দেশের এক উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ এলেন এদেশের কিষাণ জীবনের উন্নয়ন নিয়ে একটি গবেষণা করার জন্য। ধরুন, তিনি এলেন আম্রিকা থেকে! বুঝতেই পারছেন, উন্নয়নের বুদ্ধিতে তাদের মাথা ঠাসাঠাসি করে! গ্রামবাংলার ফসলের মাঠে গিয়ে প্রথমেই দেখলেন, এক কিষাণ গাছের নিচে ঘুমাচ্ছেন! আহা, এরকম অলস বলেই তো এদেশের উন্নয়ন হচ্ছে না – তিনি ভাবলেন। ডেকে তুলে কিষাণকে নাক-সোজা জিজ্ঞেস করলেন, “আপনি ঘুমাচ্ছেন, তাহলে পরিবারের উন্নয়ন কীভাবে হবে?”
কৃষক বাবাজি তো আকাশ থেকে পড়লেন। এমনিতেই দুপুরের ঘুম, তার ওপর আবার ক্ষেতের আঁলে বিদেশি মানুষ। বিদেশি তো বিদেশি – আম্রিকান বিদেশি। আধাঘুমে তিনি উত্তর দিলেন, “উন্নয়ন কী?” এরকম প্রশ্নে আম্রিকান গবেষক আকাশে তারা দেখার কথা, যদি তার বস ওই প্রশ্ন করতেন। কিন্তু এটি তো গরিবের রাজ্য বাংলাদেশ। তাই, বিন্দুমাত্র বিব্রত বা আক্রান্ত না হয়ে, বুদ্ধিতে মাথা-ঠাসা বিশেষজ্ঞের মতো তিনি বললেন, “উন্নয়ন মানে হলো আপনার অর্থনৈতিক ও সামাজিক উন্নয়ন, যাতে বুঝা যাবে আপনি সুখে আছেন – আরামে আছেন।”
এতক্ষণে কিষাণ বাবাজির ঘুম নিশ্চিত ভেঙ্গেছে। তিনি সম্পূর্ণ চোখ খোলে প্রথমে দেখে নিলেন সেই আম্রিকান উন্নয়ন বিশেষজ্ঞকে। তারপর বললেন, “আমার ঘুম দেখে কি আপনি বুঝতে পারেন নি যে, আমি সুখে ছিলাম – আরামে ছিলাম?” বলা বাহুল্য, আম্রিকান ভদ্রলোক তার দোভাষির সাহায্য ছাড়াই কিষাণের কথাগুলো বুঝে ফেলেছিলেন। তাই, দোভাষিকে ইশারা করে তিনি ফিরে গেলেন অন্য গন্তব্যে। নিজেদের চিন্তাচেতনা অন্যের ওপর চাপালে যে কী হয়, ওটা হলো একটি ছোট দৃষ্টান্ত।
এই ধরুন গণজাগরণের কথাই বলি। তরুণেরা নিজ নিজ চেতনা আর স্বদেশ প্রেম দ্বারা উজ্জীবিত হয়ে এক অভাবনীয় বিপ্লবের সূচনা করলেন। আমাদের মুরুব্বি সম্প্রদায় সকলেই একবার করে চেষ্টা করলেন নিজ নিজ চিন্তা চাপিয়ে দেবার। সরকারি দলের কর্তারা প্রথম দিনই গিয়ে ‘যথানিয়মে’ নাস্তানুবুদ হয়ে ফিরলেন। তারপর বিরোধীদল গেলো এককভাবে। একজন সাবেক নগরপিতা গিয়ে নিজ দলের এজেন্ডা উপস্থাপন করে আসলেন। দলীয়ভাবে চেষ্টা করা হলো, যেন বিরোধীদলের দাবীও তরুণেরা তাদের দাবিনামায় যুক্ত করেন। তরুণেরা তো কারও কথা শুনার পাত্র নন, কারণ তারা বিয়াল্লিশ বছরে অনেক কথা শুনেছেন।
তথ্যপ্রযুক্তির দ্রুতপ্রসারে পৃথিবীজুড়ে চলছে জ্ঞান-বিজ্ঞানের রেনেসাঁ। সমগ্র পৃথিবী আজ একটি খোলা বই। সকলেই তা পড়তে পারে, জানতে পারে, যাচাই করে দেখতে পারে। ধর্মতত্ব থেকে শুরু করে সৃষ্টিতত্ত্ব, সমাজনীতি থেকে সমরনীতি, অর্থনীতি থেকে রাজনীতি পর্যন্ত – কী নেই! যদিও মানুষ সকল বিষয়েই জ্ঞানী হতে পারে না, কিন্তু নিজ নিজ বিষয়ে ‘প্রয়োজনীয় জ্ঞান’ তারা অর্জন করে নিচ্ছে। জ্ঞানের প্রয়োজন আপেক্ষিক – বুদ্ধিজীবীরা যতই অস্থির হোন – এটি সবার জন্য এক নয়। আমার এক বন্ধুর মা-বাবা সারাটি জীবন শেষ করে দিয়েছেন নিজ গ্রামের ভিটাতে – থানা শহরেও আসতে হয় নি তাদের। তাদের জীবনের জন্য জ্ঞান ততটুকুই দরকার ছিলো। তাই জ্ঞান বিতরণের কাজটিও সাবধানে করা উচিত। কে জানে আমাদের অজান্তেই হয়তো অপ্রত্যাশিত জ্ঞান কেউ অর্জন করে নিয়েছে!
২. পাগলের দেশে সুস্থ মানুষই পাগল শিরোমণি। গল্পটি সকলেই জানেন তবু বলছি। দেশের প্রধানমন্ত্রী গেলেন পাগলা-গারদ পরিদর্শন করতে। তিনি প্রত্যেকটি মানসিক রোগীর সাথে কথা বলছেন এবং তাদের চিকিৎসার খোঁজ নিচ্ছেন হাসপাতালের পরিচালকের কাছ থেকে। পাগলদের কৌতূহলের শেষ নেই: “এতো ভাব নিয়ে কথা বলছে, ওই লোকটি কে!” তাদের মনে প্রশ্ন। একজন তো জিজ্ঞেসই করে ফেললেন, “আমনে কেডা?” প্রধানমন্ত্রী হেসে বললেন, “আমি আপনাদের প্রধানমন্ত্রী।” বিন্দুমাত্র দেরি না করে, হাত বাড়িয়ে দিয়ে পাগলটি বললো, “আমিও প্রধানমন্ত্রী। লন হাত মিলাই!”
কীভাবে বুঝবেন যে, আপনি পাগল? (পাগল) বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রতি চারজনের একজন নাকি ‘খানিকটা পাগল’।
এবার ধরুন, আপনার বন্ধুদের মধ্যে তিন জনই বেশ সুস্থ, অর্থাৎ পাগল বলা যায় না। তাহলে হয়তো আপনিই সে ব্যক্তি! এটি একটি সহজ পদ্ধতি – ভুল কিছু থাকলেও ফেলে দেওয়া যায় না।
এবিষয়ে আরেকটি পাগলের কৌতুক দিয়েই শেষ করছি লেখাটি। পশ্চিমা দেশের এক পাগলা-গারদে এক ভদ্রলোক গেলেন দেখার জন্য। তার উদ্দেশ্য হলো, মানসিক রোগী সনাক্ত করার পদ্ধতি সম্পর্কে জানা।
হাসপাতালের পরিচালককে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, “তো, কীভাবে আপনারা নিশ্চিত হোন যে, অসুস্থ ব্যক্তিটি সত্যিই পাগল এবং তাকে ভর্তি করানো উচিত?”
মানসিক হাসপাতালের পরিচালক বললেন, “সাধারণত, আমরা একটি বাথটাবে পানি ভরে এর পাশে একটি চামচ, একটি মগ ও একটি বালতি রেখে দিই। দেখি সে কোন পদ্ধতিটি বেছে নেয়, বাথটাবটি খালি করার জন্য।”
“সুস্থরা হয়তো বালতিটিকে বেছে নেবে, কারণ বালতিই সবচেয়ে বড় এবং সুবিধাজনক।” ভদ্রলোকটি বিজ্ঞের মতো মতামত দিলেন।
“না, সেটা ঠিক নয়। সুস্থ ব্যক্তিটি টাবের নিচে পানি খালি করার সু্ইচটি খুলে দেবে।” হাসপাতালের পরিচালক তখন পেশাদারি দৃষ্টিতে অথিতির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “তো আপনার বিছানাটি কি আপনি জানালার দিকে রাখতে চান?”
এবার বুঝুন, চিন্তাচেতনা সাবধানে প্রকাশ না করলে কী ফল হয়। শ্রোতার ধারণ-ক্ষমতা ও জ্ঞানের পরিধি না বুঝে কথা বললে উপরোক্ত পরিণতি ডেকে আনবে। তাই বলছিলাম, নিজ নিজ চিন্তাচেতনা নিজ দায়িত্বে রাখাটাই এখন বুদ্ধিমানের কাজ!
ছবির জন্য কৃতজ্ঞতা: themeanings.com