শাহবাগ স্কয়ারে আমরা সবাই একটি দল – বাংলাদেশ
একে রাজনৈতিক সমাবেশ বলা চলে না, কারণ এটি কোন সমাবেশের স্থান নয়। এখানে নেই কোন সভাপতি বা প্রধান অতিথি। নেতা-নেত্রীদের জৈষ্ঠতার ক্রমিক আসনও ছিলো না। নির্দিষ্ট কোন মঞ্চও নেই, ট্রাকের ওপরে স্বতঃস্ফূর্ত বক্তৃতা আর গগণবিদারী স্লোগান। রূপসী বাংলা হোটেল থেকে টিএসসি, কাঁটাবন থেকে মৎস্যভবন – স্বতঃস্ফূর্ত জনতার ঢল। মিডিয়ার সবরকমের উপস্থিতিই সেখানে ছিলো, স্যাটেলাইটসহ – কিন্তু মিডিয়ার পক্ষে এ বিপ্লবের পুরোপুরি কাভারেজ দেওয়া কঠিন। শুধু দেখতে চাইলেও শাহবাগ স্কয়ারে যেতে হবে। যেখানে প্রবীণেরা নবীনদেরকে মাথায় হাত বুলিয়ে সাহস দিচ্ছে, অশ্রুনয়নে স্লোগানে শরিক হচ্ছে অগণিত তরুন – সেখানে না গিয়ে কী বুঝা যায়? আমি বলি দেখতে নয়, শরিক হতেই চলে আসুন শাহবাগ স্কয়ারে!!
বিপ্লব বুঝি এরকমই হয়! যেসব যুবক-যুবতি একাত্তরের রণাঙ্গণের শরিক না হতে পেরে আক্ষেপ করেছিলো, আজ বুঝি তাদেরই দিন! মুক্তিযুদ্ধে বাঙালির ‘একাত্ম অজেয় শক্তি’ যারা দেখে নি, আজ তাদের দিন। এটি যেন দায়মুক্তি আর ঘাটতি পূরণের দিন। তা না হলে ‘জয় বাংলা’ ধ্বনি কেন আবার শিহরিত করবে সকলকে? তা না হলে শিশু নারী যুবক বৃদ্ধ লেখক মুক্তিযোদ্ধা ছাত্র শিক্ষক অধ্যাপক উপাচার্য – সকলেই কেন ব্লগার আর অনলাইন একটিভিস্টদের ডাকে আসবে? স্বতঃস্ফূর্ত বিপ্লব কখনও আনুষ্ঠানিকতা মানে না, মানতে পারে না।
তুমি কে আমি কে – বাঙালি বাঙালি। পদ্মা মেঘনা যমুনা – তোমার আমার ঠিকানা। দলে দলে মেয়েদের স্লোগান আসতেছিলো ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দিক হতে। গতকাল বেশি মুগ্ধ হয়েছি যখন দেখেছি বয়স্ক চাচাদেরকে এবং শশ্রুময় হুজুরদেরকে বুকে প্লাকার্ড নিয়ে স্লোগানে জ্বলে ওঠতে। মুগ্ধ হয়েছি বোনদের আত্মবিশ্বাসী অংশগ্রহণ দেখে। দলে দলে মেয়েদের তাৎপর্যপূর্ণ এবং নিঃসংকোচ অংশগ্রহণ দেখে। আমাদের বোন লাকি স্লোগান দিচ্ছিলো “ক’তে কাদের মোল্লা – তুই রাজাকার তুই রাজাকার”।
এখানে কোন নেতা নেই, নেতার গর্জন নেই। নির্দিষ্ট কোন দল একে পরিচালনাও দিচ্ছে না। অথচ সকলে এক এবং একাত্ম। স্বাধীনতার শত্রুদেরকে নির্মূল করার জন্য কোন দলের প্রয়োজন নেই – প্রয়োজন এক হওয়ার। প্রয়োজন শুধু বাঙালি হওয়ার, বাংলাদেশি হওয়ার। যে কেউ স্লোগান দিচ্ছে, তাতে সবাই সাড়া দিচ্ছে, আর্তচিৎকারে কাঁপিয়ে তুলেছে শাহবাগের আকাশ।
এতো মানুষের ভিড়ে কোন ধাক্কাধাক্কি নেই। স্থান নিয়ে নেই বিতণ্ডা। সকলেই সকলের জন্য রাস্তা করে দিচ্ছে। মা-বোনেরা নির্দ্বিধায় এগিয়ে যাচ্ছে তাদের গন্তব্যের দিকে। আমাদের সমাজে সাধারণত ভিড়ের মধ্যে মেয়ে পুরুষ হাঁটা একটু অস্বস্তিকর। কিন্তু গতকাল তা ছিলো না। শিশু, নারী আর বৃদ্ধ মায়েরা নিশ্চিন্তে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যাচ্ছিলো, তাতে ছিলো সকলের সহযোগিতা। ছিলো না ‘দুঃখিত’ বলার প্রয়োজনীয়তা। যেন সবাই সবাইকে বুঝে নিয়েছে, মেনে নিয়েছে – বিপ্লব বুঝি এভাবেই আসে!
আমি বায়ান্নো ঊনসত্তর একাত্তর দেখিনি। ঢাকায় না থাকায় নব্বুইয়ের উভ্যূত্থানও দেখার সুযোগ হয় নি। কিন্তু দু’হাজার তেরো দেখেছি। যা দেখেছি তাতে আমি মুগ্ধ অভিভুত এবং গর্বিত। একে যুব বিপ্লব বলা উচিত। যুব বিপ্লব সফল হোক। শাহবাগে আমরা সবাই এক দল – বাংলাদেশ।